হর্ষবর্ধন কে সকলোত্তরপথনাথ বলা হয় কেন

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় শক্তির পরিবর্তে একাধিক আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটে। গুপ্তদের পতনের সাথে সাথে বাংলা, পাঞ্জাব, কনৌজ প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান ঘটে এবং ঐ সকল রাজবংশের মধ্যে অন্যতম ছিলেন থানেশ্বরের (পাঞ্জাব) পুষ্যভূতি রাজবংশ।

হর্ষবর্ধন কে সকলোত্তরপথনাথ বলা হয় কেন
হর্ষবর্ধনের মুদ্রা

হর্ষচরিত গ্রন্থের বানভট্ট লিখেছেন যে, এই রাজ বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন হর্ষবর্ধন (৬০৬ খ্রি.)। তিনি আরো বলেন যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের আকস্মিক মৃত্যুতে তৎকালীন এক সংকটময় মুহূর্তে তিনি থানেশ্বরের সিংহাসনে উপবেসন করেন। ক্ষুদ্র এক রাজবংশের অধীশ্বর হলেও তিনি স্বীয় সমর কুসলতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষনতার দ্বারা থানেশ্বর সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারিত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি মূল্যায়ন প্রসঙ্গে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর পরবর্তী শাসকগণের লেখতে হর্ষবর্ধনকে সকলোত্তরপথনাথ অর্থাৎ সমগ্র উত্তর ভারতের প্রভু বা  সমগ্র উত্তর ভারতের প্রদর্শনকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হর্ষবর্ধন এই অভিধায় কতটা যোগ্য ছিলেন- তা বিচার্য।

পুষ্যভূতি হর্ষবর্ধনকে সকলোত্তরপথনাথ অভিধায় অভিহিত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক গণের মধ্যে বিতর্ক বিদ্যমান আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক হর্ষবর্ধনকে সমগ্র উত্তর ভারতের অদৃশ্যর বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক আর. কে. মুখার্জি হর্ষবর্ধনকে সমগ্র উত্তর ভারতের শাসক বলে অভিহিত করেছেন। হর্ষবর্ধনের জীবনীকার কে. এম. পানিক্কর মন্তব্যে বলেন যে, হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য হিমালয় থেকে বিন্দ পর্বত এবং কাশ্মীর থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লেখক ও সাহিত্য নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক ত্রিপাঠী এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে- পূর্ব পাঞ্জাব, মথুরা ও মালিপুর ব্যতীত সহ উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ, কোঙ্গোদ(গঞ্জাম) সহ উড়িষ্যা হর্ষের অধিকার ভুক্ত ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁকে "Last great Empire builder of the Hindu period" বলে অভিহিত করেছেন।

আধুনিক গবেষকরা হর্ষবর্ধনকে সকলোত্তরপথনাথ অভিধায় অভিহিত করতে নারাজ। অধ্যাপক মজুমদার বলেন যে, উপরোক্ত ঐতিহাসিকরা বানভট্টহিউয়েন-সাং এর অতিরঞ্জিত বক্তব্যের উপর নির্ভর করে হর্ষবর্ধনকে অভিধায় অভিহিত করেছেন। তিনি আরো বলেন যে, চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর পরবর্তী শাসকগণ নিজেদের বংশের গৌরব বৃদ্ধি করার জন্য এর বিরূপ মন্তব্য করেছেন। অনুরূপভাবে এইচ. সি. রায়চৌধুরী হর্ষবর্ধনকে সকলোত্তরপথনাথ বলে অভিহিত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

হর্ষবর্ধন কে সকলোত্তরপথনাথ বলা হয় কেন

হর্ষবর্ধন কে প্রকৃত অর্থে সকলোত্তরপথনাথ অভিধায় যোগ্য ছিলেন কিনা সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে হলে তার সম্রাজ্য সীমা অথবা সমসাময়িক শক্তির উপর তার প্রভাব বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সমকালীন কয়েকটি উপাদান যেমন- হিউয়েন-সাং এর সি ইউ কি, বাণভট্টের হর্ষচরিত, আর্য মঞ্জুশ্রির মূলকল্প প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়া হর্ষবর্ধনের মধুবন লেখ, দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল লেখ প্রভৃতি থেকে রাজনৈতিক কৃতিত্বের আভাস পাওয়া যায়। উক্ত উপাদান থেকে জানা যায় যে, হর্ষবর্ধন উত্তরাধিকারসূত্রে থানেশ্বর(পূর্ব পাঞ্জাব) এবং ভগিনি রাজশ্রী সূত্রে কনৌজ(গাঙ্গে উপত্যাকা) আধিপত্য স্থাপন করেন। উক্ত এলাকার বাইরে উত্তর ভারতের কতটা অংশে হর্ষবর্ধনের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বিচার্য, সেইসব শক্তির তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন যেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল গৌররাজ শশাঙ্ক।

শশাঙ্ক মৌখরী রাজ গ্রহবর্ধন ও রাজ্যবর্ধনকে নিহত করে কনৌজ আধিপত্য স্থাপন করেন। হর্ষবর্ধন কামরূপ রাজ(আসাম) ভাস্কর বর্মা সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন এবং দ্বিশক্তির মিলিত চাপে শশাঙ্ক কনৌজ পরিত্যাগ করেন। হর্ষচরিত এবং সি ইউ কি থেকে জানা যায় যে, হর্ষবর্ধন পরে গৌড় রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। কিন্তু হর্ষচরিত, সি ইউ কিতে এই সংঘর্ষের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্য মঞ্জুশ্রির মূলকল্পে বলা হয়েছিল যে, হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য লাভ করেছিলেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় সাম্রাজ্য অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়।

হর্ষবর্ধন উত্তর ভারতে আরো কয়েকটি দেশ যেমন- সিন্ধ, কাশ্মীর এর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ছিলেন বলে জানা যায়। এদের বিরুদ্ধে অভিযানে তিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন কিনা- এসম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ভগবান লাল ইন্দ্রজিৎ এর মতে, নেপাল হর্ষের রাজ্যভুক্ত ছিল, কারন নেপালের কোন কোন অংশে সম্ভবত এর প্রচলন লক্ষ্য করে তিনি এই ধারণা করছিলেন, কিন্তু আধুনিক গবেষণা মানতে নারাজ। হর্ষ বাঁশখেড়া লেখ প্রাপ্তিস্থান শাজাহানপুর এর ভিত্তিতে বান পার্বত্য অঞ্চল গাড়ওয়াল ও কুমায়ুন অঞ্চলের প্রতি নির্দেশ করেছেন এর উপর হর্ষের আধিপত্য ছিল।

দীর্ঘ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হর্ষবর্ধন প্রকৃত অর্থে সকলোত্তরপথনাথ ছিলেন কিনা, তা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য পূর্ব ভারত অর্থাৎ কনৌজ, বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বিস্তির্ণ হয়েছিল। কামরূপ বা আসাম এর উপর তার পরোক্ষ প্রভাব ছিল। উত্তর ভারতের অর্ধেকাংশে অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিম ভারত, কাশ্মীর, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলে তার আধিপত্য ছিল কিনা সেই ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ড. এস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “Bana and Hiuen- "Tsong were both partisan of Harsha and their statements can not be entirely historical". অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে তার সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর ফলে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রসারে পরিসমাপ্তি ঘটে, কিন্তু অধ্যাপক মজুমদার এই মত স্বীকার করেনি।

প্রকৃতপক্ষে হর্ষবর্ধন দ্বিতীয় পুলকেশীর নিকট পরাজিত হয়েছিলেন, এরফলে তার উত্তরসূরিরা নিজেদের বংশমর্যাদা অথবা পূর্বসূরিদের কৃতিত্বকে অতিরঞ্জিত করার জন্য হর্ষবর্ধনকে এরূপ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি সমগ্র উত্তর ভারতের অধীশ্বর ছিলেন না। এই সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হর্ষবর্ধন সকলোত্তরপথনাথ অভিধায় যোগ্য ছিলেন বলে মনে হয়নি।

* আবার ব্রোচ, গুজরাট অঞ্চলে বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে দুই শক্তিশালী শাসক হর্ষবর্ধন ও পুলকেশী সংঘাতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তবে এই সংঘাতে তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।

কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

👉 সকলোত্তরপথনাথ কাকে বলা হয় ?
উত্তর- হর্ষবর্ধন 

👉 হর্ষবর্ধন কোন বংশের রাজা ছিলেন ?
উত্তর- পুষ্যভূতি বংশ

👉 পুষ্যভূতি বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ?
উত্তর- প্রভাকর বর্ধন

👉 হর্ষবর্ধন কি উপাধি নিয়েছিলেন ?
উত্তর- শিলাদিত্য

👉 হর্ষবর্ধন কোন সালে মগধরাজ উপাধি নিয়েছিলেন ?
উত্তর- ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে

👉 হর্ষবর্ধন রচিত গ্রন্থের নামগুলি কি কি  ?
উত্তর- প্রিয়দর্শিকা, রত্নাবলি, নাগানন্দ

👉 হর্ষচরিত গ্রন্থটি কার লেখা ?
উত্তর- বাণভট্ট


তথ্যসূত্র

  1. সুনীল চট্টোপাধ্যায় "প্রাচীন ভারতের ইতিহাস"
  2. Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় টীকা (আরো পড়ুন)
  2. বৈদিক এবং ঋক বৈদিক যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
  3. প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য  (আরো পড়ুন)

লেখক পরিচিতি

হর্ষবর্ধন কে সকলোত্তরপথনাথ বলা হয় কেন
নাম- সুমন মোহন্ত
কলেজের নাম- নেতাজি মহাবিদ্যালয়
(২ সেমিস্টার, ইতিহাস অনার্স)
ঠিকানা- আরামবাগ, মায়াপুর,
পিন কোড- ৭১২৪১৩

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐