মুঘল ভারতের কিছু বড় শহর

ষোড়শ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সময়কাল মুঘল ভারতের নগরায়নের এক সুবর্ণ সুযোগ| শহর প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের জন্য সবচেয়ে সহায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, মুঘল শাসন আমলে শান্তির ব্যাপক বিস্তার| এছাড়াও দেশের মধ্যে স্থলপথ ও জলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছিল ব্যাপকভাবে|

সম্রাট আকবর দেশের সর্বত্রই একই ওজন, পরিমাপ ও মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন| অভ্যন্তরীণ শুল্ক তুলে দিয়ে পণ্য লেনদেনের সুবিধা করে দেওয়া হয়| যেসব স্থানের অর্থনৈতিক অবস্থা ও যোগাযোগের সুযোগ-সুবিধা বেশি, সেইসব জায়গাকে কেন্দ্র করে মুঘল আমলে শহর ও নগর গড়ে উঠেছিল|

মুঘল-ভারতের-কিছু-বড়-শহর

                   মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র

                Author- Santosh.mbahrm
               Date- 26 September 2015
             Source- wikipedia (check here)
 License- GNU Free Documentation License

                    


মুঘল আমলে ভারতীয় শহরগুলিকে মোট চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, যথা-
  1. প্রথম শ্রেণীতে ছিল দিল্লি, আগ্রা, হায়দ্রাবাদ, লাহোর ও ফৈজাবাদের মত বড় ও ব্যস্ততম রাজধানী শহরগুলি| মুঘল আমলে এগুলি ছিল প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র|
  2. দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে শিল্প-পণ্যের উৎপাদন তথা বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি| মুঘল আমলে পাটনা ও আমেদাবাদ ছিল এই ধরনের উল্লেখযোগ্য শহর| 
  3. তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় তীর্থ কেন্দ্রিক শহরগুলিকে| এই শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য শহরগুলি ছিল কাশি ও মথুরা| 
  4. চতুর্থ স্থান দেওয়া হয় সেসব শহরকে বিশেষ করে শিল্প-দক্ষতার উপর যাদের অস্তিত্ব নির্ভর করত| এই শ্রেণীর শহরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আগ্রার কাছে বায়না নীল শিল্পের জন্য এবং অযোধ্যার ফতেয়াবাদ ও দরিয়াবাদ বিশেষ ধরনের বস্ত্রের জন্য|
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি শহরের প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির জন্য আবশ্যিকভাবে পালনীয় পূর্ব শর্ত ছিল| পাঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত স্থানগুলিতে বহু নতুন নতুন শহরের পত্তন হয়| অষ্টাদশ শতকে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অশান্তি শুরু হলে অযোধ্যাকে কেন্দ্র নগরায়ন শুরু হয়|আবার 1564 খ্রিস্টাব্দের শিবাজীর আক্রমনের পর থেকে সুরাটকে কেন্দ্র করে শহরের পত্তন হয়|

মুঘল-ভারতের-কিছু-বড়-শহর
কৃষক


আকবরের আমলে সরকারি রাজস্ব নগদে আদায় শুরু হলে শহরে সংখ্যা বাড়তে থাকে| কৃষক রাজস্ব নগদে দেওয়ার জন্য উৎপাদিত রাজস্ব বাজারে বিক্রি করতে পারত না| গ্রাম-গঞ্জে বণিক, মহাজন, জমিদার, জায়গিরদার, গোমস্তা, ইমাম ইত্যাদি সপ্তভোগী গিয়ে ভিড় করে|

প্রাকৃতিক ও সমসাময়িক দিক থেকে সুরক্ষিত স্থানে পরিবহনের সুবিধা থাকলে শহর গড়ে ওঠে, যেমন- দিল্লির অবস্থান যমুনা নদীর তীরে, লাহোরের অবস্থান রাভী নদীর তীরে| তাই কাশ্মীর, মুলতান ও সিন্ধু সাথে বাণিজ্য করা লাহোরের পক্ষে বেশ সহজ ছিল| তাপ্তি নদীর মোহনায় সুরাটের অবস্থান এবং পূর্ব-পশ্চিমে সঙ্গে বাণিজ্যের সুবিধা তাকে মুঘল যুগের শ্রেষ্ঠ বন্দর শহরে পরিণত করেছিল|

শুধু বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য মুঘল যুগে অনেক শহর গড়ে উঠেছিল| অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে, "মুঘল সম্রাটরা যে রাজনৈতিক অবস্থার উদ্ভাবন করেছিলেন, সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ নীতির বিশেষ করে কৃষি ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন শহর ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য কেন্দ্রের ইউরোপীয় বাণিজ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপীয় বাজারগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন মুঘল যুগের অর্থনীতিকে বলবান করেছিল, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল নগরায়নের উপর| উত্তরের দিল্লি, আগ্রা, আমেদাবাদ, সুরাট ও ঢাকা শহরের দ্রুত সম্প্রসারণ এই সময় ঘটেছিল"|

এই সময় দ্রুত নগরায়নের মুলে আরেকটি বিষয় জড়িত ছিল- তা হলো দলে দলে কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে| তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা দ্রুত প্রসার ঘটে| অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মনে করেন, "রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের জন্য কৃষক শ্রেণী ক্রমাগত ভিখারিতে পরিণত হওয়ার একমাত্র কারণ নয়, শহরগুলিতে উন্নত মানের জীবনযাত্রা ও নগদ মজুরির প্রলোভনও ছিল"|


মুঘল-ভারতের-কিছু-বড়-শহর

           যুদ্ধ পতাকা, সাম্রাজ্য সীল, জাতীয় পতাকা

                        Author- Santosh.mbahrm
                        Date- 26 September 2015
                Source- wikipedia (check here)
       License- GNU Free Documentation License


পূর্ব উপকূলের জেলেদের একটি ছোট ও অপরিষ্কার অঞ্চল বাণিজ্যিক কারণে মুঘল যুগের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর ও বন্দরে পরিণত হয়েছিল| এই শহরটি হলো মুসলিপট্টম| এছাড়াও বাণিজ্যিক কারণে গড়ে ওঠা বন্দর-শহরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুরাট, কাম্বে, কালিকট, কচিন, চট্টগ্রাম, ঢাকা ইত্যাদি| স্থলপথে দুটি প্রধান বাণিজ্য পথ, যথা- 1. লাহোর থেকে কাবুল, 2.মুলতান থেকে কান্দাহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বলে মুঘল আমলে ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে লিখেছিলেন|

ধর্মীয় কারণে মুঘল আমলে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ শহর গড়ে উঠেছিল| ভারতের তীর্থস্থানগুলি শিল্প-বাণিজ্যে কেন্দ্রে পরিণত হয়, ফলে বনিক, কারিগর, শিল্পীদের সমাগম ঘটে| এর ফলে গড়ে ওঠে বড় বড় শহর| মুঘল যুগে বারানসী ছিল এই ধরনের বড় শহর|

আকবরের রাজত্বকালে প্রথমদিকে বাংলায় বড় শহর ছিল গৌড়| এই শহরের পরিধি ছিল প্রায় 12 মাইল| সম্ভবত মহামারীর কারণে পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে বাংলায় ছোট ছোট বাজার-শহর গড়ে ওঠে| এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যশোহর, রংপুর, সোনারগাঁও প্রভৃতি| একদিকে বারো ভূঁইয়া ও অন্যদিকে আরকালি আক্রমণ ঠেকানোর জন্য মুঘলরা ঢাকায় তাদের রাজধানী স্থাপন করে| এইভাবে জলপথে ও স্থলপথে বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বাংলার রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকে| ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে বিবরণ ও "আইন-ই-আকবরি" গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বাংলার গ্রাম ও শহরগুলি সুতি কাপড় ও রেশমী বস্ত্র শিল্পের উন্নতি ও সমৃদ্ধির কেন্দ্র স্থল ছিল|

মুঘল-ভারতের-কিছু-বড়-শহর
সুতি কাপড় 


মুঘল যুগে আকবর ফতেপুর সিক্রিতে এক শহর গড়ে তুলেছিলেন, আর শাহাজান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শাহজাহানাবাদ নামে একটি শহরের| মুঘল আমলে উত্তরপ্রদেশে অনেকগুলি নতুন শহরের পত্তন হয়| এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মুরাদাবাদ, রামপুর নাজরাবাদ গাজিয়াবাদ প্রভৃতি| বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শহরগুলি একটি দুর্গকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল| এই দুর্গ থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সব কাজকর্ম পরিচালিত হতো| শহরের মধ্যে থাকত ময়দান, জলাশয়, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাধিস্থল, সরাইখানা প্রভৃতি এবং শহরটি সাধারণত প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত রাখা হতো|

মুঘল-ভারতের-কিছু-বড়-শহর
দুর্গ


মুঘল যুগে শহরগুলির আয়তন ছিল বিশাল ও লোক সংখ্যা ছিল অনেক| অধ্যাপিকা শিরিন মুসভি দেখিয়েছেন যে, আগ্রা ছিল সবচেয়ে জনবহুল নগরী, এখানে 5.7 লক্ষ লোক বাস করতো| পাটনা বা গৌড়ের লোক সংখ্যা ছিল প্রায় 2 লক্ষ| সুরাট ও মুসলিপট্টমের লোক সংখ্যা ছিল 2 লক্ষ| মুঘল যুগে শহরগুলি স্বশাসনের অধিকার ভোগ করত|

শহরগুলি বিভিন্ন মহল্লার ভাগ করা হতো| প্রতিটি মহল্লার দেখা-শোনার ভার থাকতো পঞ্চায়েতের উপর| সেই মহল্লার কোন অভিজাত সন্ত বা জাতি প্রধান পঞ্চায়েতের সদস্য হিসাবে কাজ করতেন| সুবেদার বা ফৌজদার শহরের উপর নজর রাখতেন এবং শহরগুলির প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল কোতোয়ালের উপর| সাধারণত শহরের কোতোয়ালের কাজ ছিল শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া, কর আরোপ ও সংগ্রহ, বাজার সংক্রান্ত নিয়ম-বিধির তত্ত্বাবধান ইত্যাদি|

অধ্যাপক ইরফান হাবিব এর প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী মুঘল আমলে মোট জনসংখ্যার মাত্র 15 শতাংশ অর্থাৎ প্রায় 1.1/2 কোটি লোক ছিল শহরবাসী| কিন্তু মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ শহরবাসী হলেও দেশের উৎপাদন ও প্রশাসনিক কাজে এদের অবদান ছিল অপরিসীম|

মুঘল যুগের বৃহত্তর শহরগুলির মধ্যে কিছু ছিল শিল্প উৎপাদন ও বাণিজ্য কেন্দ্র, কিছু ছিল বন্দর শহর, কয়েকটি ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র, আবার কিছু শহরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধর্মীয় তীর্থক্ষেত্র হিসাবে| মুঘল আমলে শহরগুলি ছিল শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান| অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতায় শহরগুলিতে নিত্য-সঙ্গীত, কাব্য ও চিত্রকলার সমাদর এবং সুষমা শিল্পের বিকাশ হয়| শহর থেকে এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে|



তথ্যসূত্র

  1. সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
  3. অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
  4. Shireen Moosvi, "People, Taxation and Trade in Mughal India".

    সম্পর্কিত বিষয়

    সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                  ......................................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐