সুয়েজ সংকট কী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রধান তম সংকট ছিল 1956 সালের সুয়েজ সংকট| এই সংকটের পটভূমিতে মিশরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা এবং তার বিরুদ্ধে ইসরায়েল ও ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়|

সুয়েজ-সংকট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

সুয়েজ-সংকট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ


1952 সালের মিশরের রাজতন্ত্রের অবসানের পর জামাল আবদেল নাসের এর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়| এই সরকারের লক্ষ্য ছিল, মিশরকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী দেশে পরিণত করা| 

1955 সালে বান্দুং সম্মেলন থেকে প্রত্যাবর্তনের পরেই নাসের বিদেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন| কারণ হিসেবে বলা যায়, আরব দেশগুলির বিরোধী ইসরায়েলকে ফ্রান্সের অস্ত্র সরবরাহ, যা নাসেরের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল| 


সুয়েজ খাল জাতীয়করণের কারণ

নাসেরের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না| ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইডেন নাসেরের বিরোধী ছিলেন| মিশরকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনে অস্ত্র আমদানির জন্য আমেরিকা এবং লন্ডনের কাছে অনুকূল সাড়া না পেয়ে নাসের সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানান| দীর্ঘ আলোচনার পর 1955 সালের সেপ্টেম্বরের একটি সোভিয়েত-মিশর অস্ত্র চুক্তি সম্পন্ন হয়|

নাসেরের জোট নিরপেক্ষতা নীতি ও কমিউনিস্ট দুনিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি সুনজরে দেখেনি, ফলে 1956 সালের 19 শে জুলাই ইংল্যান্ড, মার্কিন প্রভাবিত বিশ্ব ব্যাংক মিশরের আসওয়ান বাঁধ পরিকল্পনার আর্থিক সাহায্য দানের পূর্বপ্রতিশ্রুতি পালন করতে অস্বীকার করে|

মার্কিন সরকারের এই নীতির উত্তরে 1956 সালের 26 শে জুলাই এক ঘোষণায় নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নেন| অতঃপর সুয়েজ খাল হতে প্রাপ্ত আয় আসওয়ান পরিকল্পনা/ বাঁধ রূপায়িত হবে বলে স্থির হয়| 

ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় জাতীয়করণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়| কারণ নাসেরের এই ঘোষণা উভয়েই অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের পরিপন্থী ছিল| উভয় রাষ্ট্র মিশরের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠে| 


মিশরের রাজনীতিতে সুয়েজ খাল

ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় জাতীয়করণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়| কারণ নাসেরের এই ঘোষণা উভয়েই অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের পরিপন্থী ছিল| উভয় রাষ্ট্র মিশরের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠে|

নাসেরের সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হলেও মার্কিন সরকার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিশ্বাসী ছিলেন না| মার্কিন সরকারের এই আশঙ্কা ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পক্ষপাত- "দুষ্ট পদক্ষেপ ও বলপ্রয়োগ নীতি" ফলে তৃতীয় বিশ্বে তার সম্পর্কে বিরূপ ধারনার সৃষ্টি করবে|

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে লন্ডনে সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশ গুলিকে নিয়ে এক সম্মেলনের আহ্বান করা হয়| এই সম্মেলনে মার্কিন সরকার সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব পেশ করে| কিন্তু নাসেরের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন| এরপর মিশর 1956 সালের 5 ই অক্টোবর জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সুয়েজ সংকট আলোচনার জন্য এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন| ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুয়েজ খালের উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দেয়| শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার ভেটো প্রয়োগের ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রস্তাব বাতিল হয়|

সুয়েজ-সংকট
সুয়েজ খালের ছবি

সুয়েজ-সংকট
সুয়েজ খালের ছবি


ইতিপূর্বে ফ্রান্স মিশরের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর ছিল| ফ্রান্সের উদ্যোগে ইসরায়েলকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিশর আক্রমণের জন্য এক ত্রিপাক্ষিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে| এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 29 শে অক্টোবর ইসরায়েল মিশর আক্রমণ করে এবং সুয়েজ খালের দিকে অগ্রসর হতে থাকে| 30 শে অক্টোবর ব্রিটেন ও ফ্রান্স এক যুক্ত চরমপত্র দিয়ে মিশর ও আরবকে সুয়েজ খাল থেকে দশ মাইল দূরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়| মিশর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে| অবশেষে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্যারাসুট বাহিনী মিশরের উপর আক্রমণ চালায়|

এদিকে মিশর আক্রমণের বিরুদ্ধে কমনওয়েলথ ও সমগ্র আফ্রো-এশীয় রাষ্ট্রগুলিতে প্রতিবাদের ঝড় উঠে| অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও ব্রিটেনের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল| ব্রিটেনের অভ্যন্তরে এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠে| এই যুদ্ধ ব্রিটেনের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে| অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশরের প্রতি সমর্থন জানায়| সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল যে, "মিশরের উপর আক্রমণ বন্ধ না হলে লন্ডন ও প্যারিসের উপর সেই রকেটে আক্রমণ চলবে"|

শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন না পাওয়ায় ইঙ্গ-ফরাসি রাষ্ট্রসংঘ/সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ শান্তির প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য হয়| 1956 সালের 6 ই নভেম্বরের মিশরের যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় জাতিপুঞ্জের জরুরি বাহিনী পাঠানো হয় এবং 22 শে ডিসেম্বরের মধ্যেই ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনী মিশর থেকে অপসৃত হয়|



সুয়েজ সংকটের তাৎপর্য

আন্তর্জাতিক সংকটের উপর সুয়েজ সংকট দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল|

প্রথমত,- সুয়েজ সংকট থেকে মুক্ত হবার ফলে আরব জাতীয়তাবাদ জয়ী হয়| এর ফলে মিশর শুধু সুয়েজ খালের মালিকে পরিণত হয়নি, সমগ্র আরব অঞ্চলসহ পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও মিশর ও নাসেরের গৌরব বৃদ্ধি পায়|

দ্বিতীয়ত,- সুয়েজ সংকটের মাধ্যমে মিশর ও ইসরায়েলের শত্রুতা ব্যাপকতা অর্জন করেছিল|

তৃতীয়ত,- ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয়ের উপর সুয়েজ সংকটের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে| নাসেরকে উৎখাত করার স্বপ্ন তাদের অপূর্ণ থেকে যায়| মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রভাবের অবসান ঘটে| অর্থনৈতিক দিক থেকেও ব্রিটেনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়| এই যুদ্ধে ব্রিটেনের খরচ হয়েছিল প্রায় 400 মিলিয়ন ডলার|

চতুর্থত,- সুয়েজ সংকটে প্রকৃত অর্থে লাভবান হয়েছিল রাশিয়া| এই সংকটের সময় রাশিয়া মিশরের পক্ষ অবলম্বন করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়|

পঞ্চমত,- সুয়েজ সংকট পশ্চিমী দুনিয়ায় ঐক্যের ফাটল ধরায়| মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গ-ফরাসি আক্রমনকে সমর্থন করেনি|

পরিশেষে বলা যায়, সুয়েজ সংকটের পর মধ্যপ্রাচ্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিপর্যয়ের ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হল, তা পূরণ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন করে| এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ঠান্ডা লড়ায়ের এক পরিবেশ জেগে উঠে|



তথ্যসূত্র

  1. Pavneet Singh, "International Relations ".
  2. Prakash Chandra, "international relations & comparative politics".
  3. Garrett W Brown, "The Concise Oxford Dictionary of Politics and International Relations ".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. ওপেক কি ? | What is OPEC ? (আরো পড়ুন)
  2. সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (আরো পড়ুন)
  3. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জার্মানির বিভাজন তথা বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রভাব  (আরো পড়ুন)
  4. ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ  (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................


    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐