বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের আর্থ-সামাজিক পটভূমি পর্যালোচনা করুন খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে

রোমিলা থাপারের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্যে গাঙ্গেয় উপত্যাকার বিস্তার, নতুন ধরনের কৃষি অর্থনীতির উদ্ভব, কারিগরদের সংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার প্রভৃতি এই সমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ধর্মনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তা ভাবনা।

শহরগুলিতে নতুন ও পুরাতন এর মধ্যে যে সংযোগ দেখা দিয়েছিল, তা এই পরিবর্তনকে দ্রুততর করে তুলেছিল। নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যাকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের এক পীঠস্থান। পূর্ব ভারতে মগধ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাকে কেন্দ্র করে বৈদিক ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণ ধর্ম ও সংস্কৃতির গোঁড়ামি ও আচার সর্বস্ব তার ব্যাপক বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যে নতুন ধর্মমতগুলি জন্ম হয়েছিল, তার মধ্যে জৈন ধর্ম ছিল পরিধানযোগ্য।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের আর্থ-সামাজিক পটভূমি পর্যালোচনা করুন খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে
মহাবীর

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের আর্থ-সামাজিক পটভূমি পর্যালোচনা করুন খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে
গৌতম বুদ্ধ

তথ্যসূত্র

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আলোচনার পূর্বে সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতি জানার জন্য নির্ভরযোগ্য উপাদান গুলির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার প্রয়োজন। এই সম্পর্কে আমাদের তথ্যের উৎসগুলি হলো জৈন ও ধর্মীয় বিষয়ক গ্রন্থ সমূহ, যেমন- বিনয় পিটক, অঙ্গুওরনিকার, এই সকল উপাদানগুলির ছাড়াও মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি এই বিষয়ে আমাদের বিশেষ সাহায্য করে থাকে।


সামাজিক প্রতিক্রিয়া

প্রতিবাদী আন্দোলনে উদ্ভব হয়েছিল প্রধানত অব্রাহ্মণদের মধ্যে। বৈদিক পরবর্তী যুগে সমাজ মোটামুটি ভাবে চারভাগে ভাগ হয়েছিল যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। সম্প্রতি অধ্যাপক রামস্মরণ শর্মা তাঁর "Material culture and social formation in ancient India" গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, এই বর্ণ ভিত্তিক সমাজ কোনদিনও অশান্তির পরিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। দুটি উচ্চবর্ণের লোকেরা ছিল বিশেষ সুবিধা ভোগী। তা সত্ত্বেও ক্ষত্রিয় শ্রেণীর ধর্ম কর্মে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। শুধু তাই নয় বর্ণপ্রথার জন্মের উপর অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটিও তারা ভাল চোখে দেখেননি।

অধ্যাপক শর্মার মতে, ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া নতুন ধর্মের আন্দোলনের সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের দুটি মহান পুরুষ মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ এই দুজনই ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণদের কৃতিত্বের বিরোধী।


নতুন কৃষি ও অর্থনীতির উদ্ভব

রোমিলা থাপার, রামশরণ শর্মা সম্প্রতিক গবেষকদের মধ্যে বৈদিক ব্রাহ্মণদের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্মগুলোর উদ্ভবের মূল কারণ ছিল না। অধ্যাপক শর্মার মতে, নতুন ধর্মগুলি আবির্ভাবের প্রকৃত কারণ ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের এক নতুন ধরনের কৃষিনির্ভর ও অর্থনীতির উদ্ভব। বৌদ্ধ গ্রন্থের বৃত্তি হিসাবে কৃষিকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক শর্মা তার একটি গবেষণায়, তথা তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, এই সময় লোহার অস্ত্র ব্যবহারের ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকাকে অনন্য মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে এই অঞ্চলের লাঙ্গলের ফলা নিয়মিতভাবে তৈরি করা হতো। লোহার ব্যবহারের ফলে কৃষির দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। 
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের আর্থ-সামাজিক পটভূমি পর্যালোচনা করুন খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে
লাঙ্গল
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের আর্থ-সামাজিক পটভূমি পর্যালোচনা করুন খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে

কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য আরেকটি উপাদান মানুষের কাছে অত্যন্তভাবে জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, আর সেটি হল গোরু। কিন্তু বৈদিক হিন্দুদের পূজা পার্বণের গো বলিদানের জন্য গোরুর সংখ্যা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এই সময় প্রতিবাদী আন্দোলনগুলি এই নিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তবে এই সকল রাজ্যের ব্রাহ্মণ প্রতি সম্মান দেখানো ও বৈদিক অনুষ্ঠান পালন করা কোন বাধ্যতামূলক ছিলনা। এরূপ গণ রাজ্যগুলি থেকে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের দুই নেতা গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীরের জন্ম হয়েছিল। এইভাবে দেখা যায় যে, লোহার ব্যবহারের ফলে কৃষি পরিবর্তন, নগরায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ইত্যাদির ফলে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল এবং যেগুলি প্রতিবাদী ধর্ম গুলির উত্থানের পটভূমি হিসাবে বিশেষ কাজ করেছিল।


ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার

অধ্যাপক অমলেন্দু ঘোষ দেখিয়েছেন যে, নতুন কৃষি উৎপাদনের ফলে কিছু নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি হয়েছিল। পালি গ্রন্থের এরকম প্রায় কুড়িটি নগরের কথা জানা যায়। এইসব নগরগুলিতে অসংখ্য কারিগর, ব্যবসায়ীরা বসবাস করত। এরাই প্রথম ব্যবসা-বাণিজ্যের মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেছিল। তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি মানেই বৈশ্যদের উন্নতি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ প্রভাবাধীন অঞ্চলে এই বৈশ্যদের অবস্থান তৃতীয় পর্যায় থেকে গিয়েছিলো, ফলে স্বাভাবিকভাবে বৈশ্যরা একটি নতুন ধর্মমতের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছিল। যে ধর্ম তাদের উন্নতি করবে এবং এই জন্যই মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই ধর্মগুলির উত্থানের পেছনে বিশেষ কাজ করেছিল।



তথ্যসূত্র

  1. সুনীল চট্টোপাধ্যায় "প্রাচীন ভারতের ইতিহাস" (প্রথম খন্ড)।
  2. Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
  3. Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. মগধের উত্থানের কারণ (আরো পড়ুন)
  2. ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় ভাবনা (আরো পড়ুন)।
  3. বৈদিক এবং ঋক বৈদিক যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
  4. প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য  (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
                     .......................................


    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐