সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ইতিহাস

বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল পূর্ব ইউরোপে শক্তিধর রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন| প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে লেনিন ও পরবর্তীতে স্তালিন যে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করেছিলেন, তা পরবর্তী সাত দশকের মধ্যেই ভাঙনের মুখোমুখি হয়| 1991 সালে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন সম্পূর্ণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন|

সোভিয়েত-ইউনিয়নের-পতনের-ইতিহাস

         সোভিয়েত পতাকা

সোভিয়েত-ইউনিয়নের-পতনের-ইতিহাস
যোসেফ স্তালিন



সোভিয়েত শাসন নীতি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সাম্যবাদী নেতৃবৃন্দের হাত ধরে যে সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম হয়েছিল, তা মূলত সামন্ততান্ত্রিক শোষণ নির্মূলকরণ এবং আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করতে পারেনি|

পাশ্চাত্য সঞ্জাত পুঁজিবাদী জাত থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করার জন্য এখানকার রাষ্ট্র নেতাগণ অতিমাত্রায় যে কেন্দ্রীয়করণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তার ফলে সামাজিকরণ ব্যাহত হয়েছিল| পাশাপাশি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি দলের উচ্চতম নেতৃত্বে প্রাধান্য এবং শাসন কায়েম করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল|

রাষ্ট্র পরিচালনায় দলীয় নেতৃত্ব ছাড়া আমলা ও জনসাধারণের কোনো ক্ষমতা ছিল না| K. G. B বা গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত নজরদারির দাপটে জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছিল| এর ফলে সোভিয়েত জনগণের কাছে এই শাসন হয়ে উঠেছিল শ্বাসরোধকারী|


সোভিয়েত অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতি

সোভিয়েত অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত| শিল্প স্থাপন থেকে শুরু করে শ্রমিকদের মজুরি প্রদান সবই রাষ্ট্র Command System- এর মাধ্যমে নির্ধারণ করত| স্তালিনের আমলে ভারী শিল্প উৎপাদনের দিকে জোর দেওয়া হলেও তা চাহিদার তুলনায় ছিল অপ্রতুল|

খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত ছিল না, পাশাপাশি ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হলে মার্কিন বেষ্টনী নীতির মোকাবেলা করতে গিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপুল পরিমাণ সম্পদ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণে বরাদ্দ হতে থাকে| ফলে জনগণের মাথাপিছু আয় ও ব্যয় দুটোই কমে যেতে থাকে|

সোভিয়েত রাশিয়া ছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এবং 15টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র| এই প্রজাতন্ত্রে কেবলমাত্র পুরুষ জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য সমাজ এবং রাজনীতিতে অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে এক হীনমন্যতার সঞ্চার করে|

সোভিয়েত-ইউনিয়নের-পতনের-ইতিহাস


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমলা, পুলিশ এবং সেনাবাহিনী শক্তিশালী হয়ে উঠে| সেনা ও আমলাদের উপর নজরদারির স্বৈথিলের কারণে কমিউনিস্টরা বহু নেতাকে হত্যা করা হয়| উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিকতাকে সরিয়ে পুঁজিবাদ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে|


নিকিতা ক্রুশ্চেভ

নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসার পর স্তালিনের সংস্কারগুলি অপসরণ করে এবং সাম্যবাদকে তিনি এক জীবনমুখী রূপ দিতে চেয়েছিলেন|

সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে এবং বাইরে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে চেয়েছিলেন| এইভাবে ক্রুশ্চেভের হাত ধরে "সোভিয়েত সম্প্রসারণবাদর" সূচনা হয়|



লিওনিদ ব্রেজনেভ

ক্রুশ্চেভের পরবর্তীতে "লিওনিদ ব্রেজনেভ" এর শাসনকালে সোভিয়েত রাষ্ট্রে এক দলীয় ব্যবস্থা নির্মূলভাবে বলবৎ হয়| পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোর করা হয়|

এছাড়া আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া প্রভৃতি স্থানে রুশ সেনা মোতায়ন ও ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের আর্থিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেই| কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যাপকহারে হ্রাস পায় এবং রাশিয়া ক্রমশ আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে|


মিখাইল গর্বাচেভ 

ব্রেজনেভের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্ত করার জন্য অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হয়| তিনি সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে 1985 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি 27 তম অধিবেশনে "গ্লাসনস্ত"  এবং "পেরেস্ত্রইকা" নীতি ঘোষণা করেন|

গ্লাসনস্ত ছিল মুক্তমনা হবার জন্য গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও স্বাধীন সমালোচনা নীতি এবং পেরেস্ত্রইকার মূল অর্থ ছিল পরিবর্তন, পুনর্গঠন এবং বিশেষত অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন সংস্কার| এই দুটি নীতির মাধ্যমে গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রের অবসান, সর্বজনীন ভোটাধিকার, রাষ্ট্রনীতির গণতন্ত্রীকরণ, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনীতি ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করেছিলেন|


বরিস ইয়েলৎসিন

গর্বাচেভের পরবর্তী রাষ্ট্রনেতা বরিস ইয়েলৎসিন এই সংস্কারগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিরোধ দেখা দেয়| ইয়েলৎসিন পার্টির সদস্য পদ ত্যাগ করেন| রক্ষণশীলরা এই সংস্কারগুলিকে মানতে চায়নি|

জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান প্রমুখ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে সোভিয়েত রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা দেখা দেয়| 1990 এর মার্চে এস্তোনিয়া লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও হাঙ্গেরি সোভিয়েত আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসে|


সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন

ইয়েলৎসিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক গণভোটের ডাক দিলে 9 টি প্রজাতন্ত্র এই গণভোটে অংশ নেই| কিন্তু জর্জিয়া, মোলডাভিয়া, কাজাখস্তান ও তিনটি বাল্টিক রাজ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে গণভোটে অংশ গ্রহণ করেনি| ইতিমধ্যে সোভিয়েত রাষ্ট্রে ও কমিউনিস্ট পার্টিতে ইয়েলৎসিন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়|

উদারপন্থী ইয়েলৎসিন লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেন|  ইতিমধ্যে 24 শে আগস্ট কমিউনিস্ট পার্টিতে এক অভ্যুত্থান দেখা দিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাকি প্রজাতন্ত্রগুলি আনুগত্যের অবসান ঘটে|

4 ই ডিসেম্বর ইউক্রেন, বেলারুশ প্রমূখ রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ মিন্সক শহরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য বিলুপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে commonwealth of independent states ( CIS ) গঠন করে| 1991 সালে 25 শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি ঘটে|


মূল্যায়ন 

1987 খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাস থেকে গর্বাচেভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনের যে শীতলতা আমদানি করেছিল, তা সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থা পক্ষে ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর ছিল| তিনি স্তালিনীয় ধারায় পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটিয়ে অতিকেন্দ্রীক প্রভুত্ববাদের অবসান করে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে কার্যকর করে তুলতে চেয়েছিল|

কিন্তু এক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ও যুগোপযোগী মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গঠনের আড়ালে তার অসারত্বকে প্রকট করে তুলেছিলেন| বিকল্প পুনর্গঠনমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারায়, সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ পুনর্নির্মাণের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় কারণে গর্বাচেভ প্রসূত উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল|



তথ্যসূত্র

  1. Pavneet Singh, "International Relations ".
  2. Martin McCauley, "The Rise and Fall of the Soviet Union".
  3. P. M. H. Bell, "The World Since 1945: An International History".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় উপনিবেশবাদের পতন তথা এর গুরুত্ব (আরো পড়ুন)
  2. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জার্মানির বিভাজন তথা বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রভাব  (আরো পড়ুন)
  3. ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ  (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐