মোগল বা মুঘল শাসন ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারি ব্যবস্থার প্রচলন| সম্রাট আকবরের সময় এই ব্যবস্থা সুসংহত রূপ লাভ করে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান ভিত্তিতে পরিণত হয়| অবশ্য এই ব্যবস্থায় আকবরের সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্ভাবন নয়, মধ্য এশিয়া অঞ্চলে প্রায় এই ধরনের ব্যবস্থা আগে থেকেই চালু ছিল|
আকবর সামরিক বাহিনীর দুর্নীতি দূর করে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য 1577 খ্রিস্টাব্দে(তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে এই সালটিকে নিয়ে) এই মনসবদার ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটান| মুঘল আমলে প্রশাসনিক পদ হিসাবে মনসবদার শব্দটি পাওয়া যায়| মনসব কথাটির অর্থ হল এক কথায় "পদমর্যাদা"| সাধারণভাবে পদাধিকারী কর্মী গোষ্ঠী মনসব নামে অভিহিত হত|
![]() |
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র
Author- Santosh.mbahrm
Date- 26 September 2015
|
মনসবদারী ব্যবস্থা প্রবর্তনে আকবরের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যের কথা ঐতিহাসিক আরভিন বলেছেন, এগুলি হল-
- মনসবের অধিকারীকে মুঘল সম্রাটের কর্মচারী রূপে প্রমাণিত করা|
- পদমর্যাদা অনুযায়ী মনসবদারদের বেতন নির্দিষ্ট করা|
- মনসবদারদের নির্দিষ্ট সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী রাখা এবং প্রয়োজনে সম্রাটকে সাহায্য করতে বাধ্য করা| তবে অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায় অবশ্য মনে করেন যে, মনসব কথাটি অলৌকিক| কারণ সকল কর্মচারীর সামরিক পদক্ষেপ থাকলেও সবার ক্ষেত্রে সামরিক কর্তব্য বাধ্যতামূলক ছিল না|
![]() |
যুদ্ধ |
মনসবদার পদে মনোনয়নের জন্য সম্রাটের ইচ্ছা ছিল শেষ কথা| উচ্চ কর্মচারীদের সুপারিশকে সাধারণভাবে সম্রাট মর্যাদা দিতেন| নিয়মানুযায়ী মীরবক্সী মনসব প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে সম্রাটের কাছে পেশ করতেন| সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীদের সাহায্যের পর তার সিদ্ধান্ত জানাতেন| সম্রাটের অনুমোদিত নামগুলি দেওয়ান ও মীরবক্সীর কার্যালয়ে নথিভুক্ত করা হতো, এরপর উজির মনসব প্রার্থীদের নিয়োগপত্র প্রদান করতেন|
"আইন-ই-আকবরী" গ্রন্থে আবুল ফজল 66টি স্তর উল্লেখ করেছেন, আবার একই গ্রন্থে সমকালীন মনসবদারদের নাম ও বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি 33টি স্তরের কথা জানিয়েছেন|
অধ্যাপক এ.সি. ব্যানার্জি মনে করেন যে, "সম্ভবত আকবর 66 টি স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত 33টি স্তর গঠন করতে পেরেছিলেন"| সাধারণভাবে 5 হাজারের উপরে মনসবগুলি সাধারণত রাজপুতদের দেওয়া হতো| তবে মান সিংহ, টোডরমল, কুঁলি খা সম্রাটের প্রতি বিশ্বাস ভাজন হওয়ায় "সব হাজারী মনসবদারি" দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন| মুঘল যুগে মনসবদারদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানি, আফগান, ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত ও মারাঠি|
রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে আকবর মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেও আধুনিক গবেষকদের মতে এটি বিভিন্ন পর্যায় সংশোধিত হয়ে 1593 খ্রিস্টাব্দের নাগাদ পূর্ণ রূপ নিয়ে ছিলো| প্রাথমিকভাবে এতে বিভিন্ন মনসবদারদের সৈন্য সংখ্যা ও পদমর্যাদা নির্দিষ্ট করা ছিল, কিন্তু অধিকাংশ মনসবদার নির্দিষ্ট চেয়ে কম সৈন্য রাখতেন| এই ত্রুটি দূর করার জন্য রাজত্বের 40 তম এই ব্যবস্থায় জাট ও সওয়ার নামে দুটি পদের প্রবর্তন করেন| জাট ও সওয়ার পদে ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে|
ব্লকমনের মতে, "জাট হল মনসবদারদের অধীনস্থ সৈন্য সংখ্যা এবং সওয়ার হল অশ্ব সংখ্যা"| আরভিন এবং আব্দুল আজিজ মতে, "জাট হল অশ্বারোহী সেনা ও সওয়ার হলো অতিরিক্ত সেনা"| আবার অধ্যাপক R. P. Tripathi মনে করেন যে, সওয়ার হলো মনসবদারদের বাড়তি মর্যাদা| Ashirbadi Lal Srivastava মত পোষণ করেছেন যে, জাট ও সওয়ার হল পদমর্যাদা সূচক|
জাট ও সওয়ার ব্যাখ্যার অনুপাত অনুযায়ী মনসবদারদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
অধ্যাপক এ.সি. ব্যানার্জি মনে করেন যে, "সম্ভবত আকবর 66 টি স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত 33টি স্তর গঠন করতে পেরেছিলেন"| সাধারণভাবে 5 হাজারের উপরে মনসবগুলি সাধারণত রাজপুতদের দেওয়া হতো| তবে মান সিংহ, টোডরমল, কুঁলি খা সম্রাটের প্রতি বিশ্বাস ভাজন হওয়ায় "সব হাজারী মনসবদারি" দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন| মুঘল যুগে মনসবদারদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানি, আফগান, ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত ও মারাঠি|
রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে আকবর মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেও আধুনিক গবেষকদের মতে এটি বিভিন্ন পর্যায় সংশোধিত হয়ে 1593 খ্রিস্টাব্দের নাগাদ পূর্ণ রূপ নিয়ে ছিলো| প্রাথমিকভাবে এতে বিভিন্ন মনসবদারদের সৈন্য সংখ্যা ও পদমর্যাদা নির্দিষ্ট করা ছিল, কিন্তু অধিকাংশ মনসবদার নির্দিষ্ট চেয়ে কম সৈন্য রাখতেন| এই ত্রুটি দূর করার জন্য রাজত্বের 40 তম এই ব্যবস্থায় জাট ও সওয়ার নামে দুটি পদের প্রবর্তন করেন| জাট ও সওয়ার পদে ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে|
ব্লকমনের মতে, "জাট হল মনসবদারদের অধীনস্থ সৈন্য সংখ্যা এবং সওয়ার হল অশ্ব সংখ্যা"| আরভিন এবং আব্দুল আজিজ মতে, "জাট হল অশ্বারোহী সেনা ও সওয়ার হলো অতিরিক্ত সেনা"| আবার অধ্যাপক R. P. Tripathi মনে করেন যে, সওয়ার হলো মনসবদারদের বাড়তি মর্যাদা| Ashirbadi Lal Srivastava মত পোষণ করেছেন যে, জাট ও সওয়ার হল পদমর্যাদা সূচক|
জাট ও সওয়ার ব্যাখ্যার অনুপাত অনুযায়ী মনসবদারদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
- যেসব মনসবদারদের জাট ও সওয়ার সংখ্যা সমান, তাদের প্রথম শ্রেণীর মনসবদার বলা হয়|
- সওয়ারের সংখ্যা জাটের সংখ্যার অর্ধেক, তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর মনসবদার|
- আর তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন সেইসব মনসবদার, যাদের সওয়ারের সংখ্যা ছিল জাট সংখ্যার অর্ধেকেরও কম|
![]() |
পদাতিক সৈন্য |
মনসবদাররা সৈন্য সংগ্রহ করে তাদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নিতেন| মূলত নির্দিষ্ট ভাতা থেকে তাদের অস্ত্র কিনতে হত| আবার অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাদের জন্য এককালীন অর্থ মঞ্জুর করত| প্রতি বছর বা প্রতি তিন বছর অন্তত তার বাহিনীকে সম্রাট বা সেনাধ্যক্ষের সামনে পরিদর্শনের জন্য হাজির করতে বাধ্য থাকতেন| মনসবদারদের বেতন হত দুইভাবে- নগদে ও জমি বন্দোবস্তের মাধ্যমে| যারা নগদে বেতন পেত, তাদের বলা হতো মনসবদারি নগদী এবং যারা নির্দিষ্ট জমি রাজস্বের অধিকারী হতেন, তারা জায়গীরদার নামে পরিচিত হন| তবে মনসবদাররা সাধারণভাবে বংশানুক্রমিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না|
প্রথমত- মুঘল মনসবদাররা রাষ্ট্রকে নানাভাবে প্ররোচনা করত| সমকালীন লেখক বদাউনি লিখেছেন যে, এরা যেকোন লোককে সরকারি পরিদর্শনের সময় সৈনিক হিসেবে দেখিয়ে নির্দিষ্ট ভাতা আত্মসাৎ করত| অনেক ক্ষেত্রে এরা নিম্নমানের ঘোড়া রাখত এবং সৈনিকদের ব্যক্তিগত প্রতিভার ও উদ্যোগে এই ত্রুটি দূর হলেও পরবর্তীকালে উচ্চাসী শাসকের অভাবে তা প্রবল ভাবে প্রকাশিত হয়, যা সমগ্র প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয়|
দ্বিতীয়ত- মুঘল সৈন্য বাহিনী ছিল কার্যত মনসবদারদের অধীন| আকবরের সময় কিছু মনসবদারদের বদলি করা হলেও পরবর্তীতে এই বদলি ব্যবস্থা উঠে যায়| অন্যান্য মুঘল সৈন্যরা অনুগত থাকতো মনসবদারদের প্রতি, সম্রাটের প্রতি নয়| উপরন্ত সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সৈন্য নিয়োগ ও বেতনের দায়িত্ব নিলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়|
তৃতীয়ত- আকবর এই ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তিনি নগদ বেতন ব্যবস্থার উপর জোর দেন| কিন্তু পরবর্তীতে অদূরদর্শিতায় জায়গীর প্রদান প্রথা ব্যাপকত্ব লাভ করে, যা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানাই|
সর্বোপরি মুঘল সম্রাটেরা মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকায় দুই ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়-
জায়গির সংকট
আকবরের শাসনকালে মনসবদারি ব্যবস্থা তার ব্যক্তিগতভাবে দক্ষতায় সাফল্য লাভ করেছিল| তা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থার কিছু অন্তর্নিহিত ত্রুটি ছিল| যা আকবরের পরবর্তীকালে বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে সরাসরি প্রকাশিত হয়ে মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংকট সৃষ্টি করেছিল|প্রথমত- মুঘল মনসবদাররা রাষ্ট্রকে নানাভাবে প্ররোচনা করত| সমকালীন লেখক বদাউনি লিখেছেন যে, এরা যেকোন লোককে সরকারি পরিদর্শনের সময় সৈনিক হিসেবে দেখিয়ে নির্দিষ্ট ভাতা আত্মসাৎ করত| অনেক ক্ষেত্রে এরা নিম্নমানের ঘোড়া রাখত এবং সৈনিকদের ব্যক্তিগত প্রতিভার ও উদ্যোগে এই ত্রুটি দূর হলেও পরবর্তীকালে উচ্চাসী শাসকের অভাবে তা প্রবল ভাবে প্রকাশিত হয়, যা সমগ্র প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয়|
দ্বিতীয়ত- মুঘল সৈন্য বাহিনী ছিল কার্যত মনসবদারদের অধীন| আকবরের সময় কিছু মনসবদারদের বদলি করা হলেও পরবর্তীতে এই বদলি ব্যবস্থা উঠে যায়| অন্যান্য মুঘল সৈন্যরা অনুগত থাকতো মনসবদারদের প্রতি, সম্রাটের প্রতি নয়| উপরন্ত সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সৈন্য নিয়োগ ও বেতনের দায়িত্ব নিলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়|
তৃতীয়ত- আকবর এই ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তিনি নগদ বেতন ব্যবস্থার উপর জোর দেন| কিন্তু পরবর্তীতে অদূরদর্শিতায় জায়গীর প্রদান প্রথা ব্যাপকত্ব লাভ করে, যা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানাই|
সর্বোপরি মুঘল সম্রাটেরা মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকায় দুই ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়-
- অস্বাভাবিক হারে বর্ধিত মনসবদারদের দাবি মেটানোর জন্য বহু খাস জমিকে জায়গীর জমিতে রুপান্তর করতে হয় এবং সরকারের আয় কমে যায়|
- নবীনযুক্ত মনসবদারদের অনেকেই জায়গীর জমি স্বল্পতার জন্য জমি পেতে বহুদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়|
পরিশেষে আমরা এই কথা বলতে পারি যে, এই জায়গির সংকট মুঘল শাসনের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলে ছিল|
তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
সম্পর্কিত বিষয়
- ভারতবর্ষে মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ও কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................