মূল্য বিপ্লব এবং ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় অর্থনীতির উপর এর প্রভাব কি ছিল

ষোড়শ শতকে ইউরোপের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো "মূল্য বিপ্লব"| এই শতকে খাদ্যশস্যের চাহিদা বেড়ে ছিল, সেই সঙ্গে খাদ্যশস্যের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ| অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের দাম বাড়লেও খাদ্যশস্যের মতো উচ্চ হারে মূল্য বৃদ্ধি ঘটেনি| 

মূল্যের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঐতিহাসিকরা মূল্য বিপ্লব বলে বর্ণনা করেছেন| সমসাময়িক পর্যবেক্ষকদেরও এই "মূল্য বিপ্লব" দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল|

মূল্য-বিপ্লব
মুদ্রা


ঐতিহাসিকরা মূল্য বিপ্লবের কারণ গুলিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন| রিয়ালিস্ট ঐতিহাসিকেরা মনে করেছেন, মূল্য বৃদ্ধির কারণ বর্ধিত চাহিদা, যার পিছনে আছে জনসংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি| তাদের কাছে মুদ্রার বর্ধিত যোগানের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল| 

মনিটারিস্ট স্কুলের প্রবক্তারা মনে করেন, মুদ্রার যোগান ভীষণ ভাবে বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল| এর পিছনে ছিল আমেরিকা থেকে মূল্যবান ধাতুর বিপুল আমদানি, বিশেষ করে 1550 সালের পরে| সর্বমিলিয়ে 1503-1650 এর মধ্যে সোনা ও রুপা মিলিয়ে মোট 220664 টন আমদানি করা হয়েছিল| ব্রদেল ও স্পুনারের মতে, এই আমদানির ফলে মুদ্রার যোগান প্রায় 50% বেড়ে ছিল| ব্রদেলের সিদ্ধান্ত এই যে, মূল্য সঙ্গে ধাতুর আমদানির পঞ্চবার্ষিকী গড়ের সামঞ্জস্য থেকে এটা বোঝা যায় যে, ধাতুর আমদানির ফলে মুদ্রার যোগান ও সঞ্চালনের গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং আমেরিকা থেকে আমদানি করা ধাতু সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, এর ফলে সর্বত্রই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল| 

মনিটারিস্ট ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ সম্প্রীতি ধাতুর মুদ্রার যোগান ছাড়াও ঋণ ব্যবস্থার উদ্ভবকে মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন| তাদের মতে, নতুন ধরনের এবং পর্যাপ্ত ঋণ ব্যবহার করার ফলেও অর্থের যোগান বেড়েছিল| কিন্তু সমালোচকরা বলেছেন, যে পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে ব্যবহার করা যেত, তা অর্থের যোগানের ধারা সীমাবদ্ধ ছিল|

আবার কিছু ঐতিহাসিক মূল্যবান ধাতুর আমদানি, অর্থের বর্ধিত যোগানের বাইরের মূল্যবৃদ্ধির অন্যান্য কারণ অন্বেষণ করেছেন,
  1. প্রথমত, ষোড়শ শতকে নতুন রাষ্ট্রের উত্থান প্রশাসনের ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল, ফলে রাজারা প্রায়শই বর্ধিত কর চাপাতেন, এর ফলেও মুদ্রাস্ফীতির হয়েছিল| 
  2. দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি| ফলে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ফারাক বেড়েছিল এবং সেজন্য মূল্য বৃদ্ধি হয়েছিল|
  3. তৃতীয়ত, অর্থনীতির বিকাশ বিশেষ করে সাগরপারের বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, কিছু মানুষের হাতে অর্থ এনে দিয়েছিল| এই বর্ধিত সম্পদের যোগান বা পরিষেবা খুব বেশি বাড়েনি, ফলে চাহিদা ও যোগানের মধ্যকার ফারাক বেড়েছিল এবং সেজন্য মূল্য বৃদ্ধি হয়েছিল |
অনেকে সাধারণভাবে মূল্যবৃদ্ধিকে রেনেসাঁস যুগের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফল হিসেবে দেখেছেন| ভৌগলিক অভিযান, সাগরপারের বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, ইউরোপের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিকাশ, শহরাঞ্চলের বৃদ্ধি ইত্যাদি ঘটনা ইউরোপের অর্থনীতিকে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল "মূল্য বিপ্লব" তারই অংশ| 

সুতরাং বলা যায়, বিভিন্ন কারণের সমাবেশে ষোড়শ শতকে ইউরোপে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল|



মূল্য বিপ্লবের ফলাফল 

ইউরোপীয় অর্থনীতিতে মূল্য বিপ্লবের ফলাফল ছিল সর্বাত্মক| মূল্য বিপ্লবের ফলে ইউরোপের সর্বত্র খাজনা বেড়েছিল| বাণিজ্য শুরু করেছিল, সেই সঙ্গে ফাটকাবাজিও বেড়েছিল| সর্বত্র জমির দাম বেড়েছিল, সেই সঙ্গে জমির বাজার গড়ে উঠেছিল| সব দেশে কমবেশি গ্রামীণ মধ্যবিত্তের আবির্ভাব ঘটেছিল| ভূস্বামীরা জমির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির লিজ দিতে শুরু করেন| ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ রাজস্বদাতার সঙ্গে চুক্তি হয় এবং জমির লিজ নিয়ে ফাটকাবাজিও শুরু হয়ে যায়|

মূল্য-বিপ্লব
কৃষক

মূল্য-বিপ্লব
কৃষি


মূল্য বিপ্লবের ফলে পুঁজিপতিরা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পুঁজি সরিয়ে নিয়ে জমিতে লগ্নি করেন| ইউরোপের সর্বত্র ব্যাংকিং পরিবারগুলি যেমন- ওয়েলসার ও ফুগার জমি বন্ধক রেখে ঋণ দিতে থাকে| বণিক, খনির মালিক, বস্ত্র উৎপাদন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমলা সকলে জমি কিনতে থাকে| ছোট ছোট বণিক ও কারিগরও জমির মূল্য বুঝেছিল, তারাও জমি কিনতে শুরু করে দেয়|

ইংল্যান্ডের গ্রামীণ জীবনের উপরেও মূল্য বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল| ভূস্বামীরা বেশি খাজনা নিয়ে জমি বন্দোবস্ত করেন, জমি ঘিরে নিয়ে অনেক ভূস্বামী পশম ও মাংসের জন্য ভেড়ার চাষ শুরু করেন| এজন্য গ্রামের ভূমিহীন কৃষক-শ্রমিক কাজ হারিয়েছিল| গ্রামাঞ্চলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল| গ্রামের তাঁতি, কসাই, চর্মকার প্রমুখ নিম্নবর্গের মানুষ জমি কিনতে থাকায় গ্রামীণ শান্তি ও গ্রামীণ সমাজ বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল|

মূল্য বিপ্লবের ফলে কৃষির বাণিজ্যিকরণ শুরু হয়েছিল| লাভজনক অর্থকরী কৃষিজ পণ্য যেমন- পশম, তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, তেমনি উৎপাদন ব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রসার ঘটেছিল| নিজের ভোগের জন্য নয়, বাজারের চাহিদার দিকে তাকিয়ে লাভের আশায় কৃষিজ পণ্য চাষ শুরু হয়েছিল| বুর্জোয়ারা এরফলে লাভবান হয়েছিল, শিল্প বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে আবার শিল্প-বাণিজ্য থেকে পুঁজি গড়ে উঠে| এক কথায় বলা যায়, মূল্য বিপ্লব ছিল শিল্প বিপ্লবের অগ্রদূত|

অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে কৃষক ও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি, তাদের আয়ের একটা বড় অংশ খাদ্য শস্যের জন্য ব্যয় হয়ে যেত| জমির খাজনা বাড়ার জন্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়| গ্রামীণ অর্থনীতিতে অশান্তি ও অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল, যা কৃষক বিদ্রোহ রূপে অন্তিমে প্রকাশ পায়| এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ছিল, 1525 সালে জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ|


তথ্যসূত্র

  1. অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
  2. C. Warren Hollister, "Medieval Europe: A Short History".
  3. Simon Jenkins, "A Short History of Europe".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐