প্রথম আফিম যুদ্ধ

1839 সালে চীন দেশের সঙ্গে ইংরেজদের সর্বপ্রথম যে শক্তি পরীক্ষা হয়েছিল, তা সর্বপ্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ নামে পরিচিত| আবার চীনারা এই যুদ্ধকে প্রথম আফিম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছে| কারণ তাদের মতে, ইংরেজগণ কর্তৃক চীনদেশে আফিমের ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করার সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তই এই যুদ্ধের সৃষ্টি করে| 

অবশ্য ইংরেজ এই মতের বিরোধিতা করে বলেছে যে, যেরূপ বোস্টন বন্দরে চায়ের বাক্স জলে নিক্ষেপ করার ঘটনাই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়নি, সেইরূপ চীনদেশে ইংরেজগণ কর্তৃক আফিম আমদানি ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের সূচনা করেনি|

প্রকৃত কারণ জানতে হলে আমাদের ইঙ্গ-চীন সম্পর্ক গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন| বাস্তবিকই আফিম সমস্যা অপেক্ষা গভীরতর কারণে প্রথম ইঙ্গ-চীন বা প্রথম আফিম যুদ্ধের সূচনা করেছিল|

প্রথম-আফিম-যুদ্ধ
বোস্টন বন্দর

প্রথম-আফিম-যুদ্ধ
চীনের মানচিত্র



প্রথম আফিম যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ববর্তিতা কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে বিদেশিদের চীন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হতো| ক্যান্টন বন্দরই ছিল বিদেশিদের বাণিজ্যের মূল ঘাঁটি| চীনা কর্তৃপক্ষের শর্তানুসারে ক্যান্টন ব্যবসা পরিচালিত হতো| তাদের ব্যবসা পরিচালিত হতো "কো-হং" সংস্থাভুক্ত "হং" নামে এক চীনা বনিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে| স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলে বিদেশি বণিকেরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, ক্যান্টনে পশ্চিমে বণিকেরা তা পেত না| এমনকি তারা যেসব বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল, তাদের প্রতি কৃপাবশত মাঞ্জু সরকার দিয়েছিল| তা কখনোই অধিকার হিসেবে দাবি করতে পারত না|

কিন্তু বিদেশিদের বিশেষ করে ইংরেজরা এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন মেনে নিতে রাজি ছিল না| এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব|শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপে বিশেষত ইংল্যান্ডের সম্পদ ও জনসংখ্যার অভাবনীয় বৃদ্ধি ঘটে| ইংল্যান্ডে পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিশেষত অনগ্রসর দেশে বিভিন্ন শিল্পে তাদের শিল্প ভিত্তিক ব্যবসা প্রসৃত উদ্ভূত ও সঞ্চয় বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়|

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সময় ইংল্যান্ড ছিল সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক শক্তি| এখন থেকে ইংরেজদের পক্ষে চীন দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সহজ ছিল| সেইজন্য ইংল্যান্ড চীন দেশের সঙ্গে নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য এবং সমতার ভিত্তিতে চীন দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল| কিন্তু এক্ষেত্রে ইংরেজদের দৌত্য প্রচেষ্টা মাঞ্চু সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাবের জন্য ব্যর্থ হয়|

এরূপ পরিস্থিতিতে চীনে বসবাসকারী ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তাদের সরকারকে সামরিক শক্তির সাহায্যে মাঞ্চু সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করানোর জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে| প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার সামরিক শক্তির সাহায্যে এই সমস্যা সমাধানের বিরোধী ছিল| শেষ অব্দি আফিম এর প্রশ্ন উভয় দেশকে সংঘর্ষের মুখোমুখি ঠেলে দেয়| সুতরাং আফিম সমস্যা ব্যতিরেকেই এই যুদ্ধ ঘোষিত হত| হয়তো যুদ্ধ ঠিক 1839 সালে সংঘটিত না হয় আগে বা পরে সংঘটিত হতো|

প্রথম-আফিম-যুদ্ধ
ব্রিটিশ সৈনিক

প্রথম-আফিম-যুদ্ধ
ব্রিটিশ পতাকা


এই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণে আফিম চীন দেশে আমদানি হতো| চীনের সর্বস্তরের মানুষ এই নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে| এই আফিম সেবনের ফলে একদিকে চীনা জনগণের যেরূপ কর্মশক্তি নষ্ট হচ্ছিল, অপরদিকে আফিমের বিরামহীন আমদানির ফলে দেশ থেকে রৌপ্য মুদ্রার ক্রমবর্ধমান নিষ্কাশন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিপর্যস্ত করেছিল|

চীনা সরকার এই সর্বনাশা আফিমের ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও কোনো কার্যকরী ফল হয়নি| শেষ পর্যন্ত এই আফিমের ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করার জন্য মাঞ্চু সরকার মরিয়া হয়ে উঠে| এই জন্য লিন নামে এক ব্যক্তিকে বিশেষ কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়| তিনি ব্রিটিশ  সুপারেন্টেন্ড ক্যাপ্টেন এলিয়ট সমেত 350 জন ব্রিটিশ বণিককে কুঠরিতে সাময়িকভাবে বন্ধ করেন এবং ব্রিটিশ বণিকদের সমর্পণ করা 20,000 আফিমের বাক্স বিনষ্ট করে দেন| এইভাবে পরিস্থিতি যখন ক্রমশ জটিল ও উত্তেজনা পূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তখন জনৈক চীনা গ্রামবাসী এক অপ্রকৃতিস্থ ইংরেজ নাবিক কর্তৃক নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের সূচনা হয়| 1839 সালে এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় মাঞ্চু সরকার 1841 সালে ইংরেজদের সঙ্গে নানকিং এর চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়|




নানকিং চুক্তির শর্ত

নানকিং চুক্তির শর্তানুসারে-
  1. হংকং দ্বীপ ব্রিটেনের অধিকারভুক্ত হয়|
  2. চীন ক্ষতিপূরণ বাবদ ইংরেজ সরকারকে 21 মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়| 
  3. চীনের ক্যান্টন, অ্যাময়, ফুচাও, নিংকো এবং সাংহাই বন্দরগুলি ব্রিটিশ বণিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়|
  4. স্থির হয় যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রতি বন্দরে একজন কনসাল নিযুক্ত হবে|
  5. কো-হং বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বাতিল করা হয়| 
  6. সর্বোপরি স্থির হয় যে, চীন বিদেশী পণ্যের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক ধার্য করবে| তবে সন্ধি পত্রে আফিম সংক্রান্ত কোন শর্তের উল্লেখ করা হয়নি|


নানকিং চুক্তির গুরুত্ব

বিভিন্ন কারণে নানকিং এর সন্ধি সুদূর প্রাচ্যে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্ন হিসেবে বিবেচ্য|

প্রথমত- এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে চীনের দুর্বলতা প্রকাশ পেল| চীনের এই দুর্বলতার সুযোগে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ চীনের ওপর একের পর এক অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়| এর ফলে চীনের মর্যাদা ধুলিস্যাৎ হয়| এযাবৎকাল চীন নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে যে উচু ধারণা পোষণ করত এবং এবিষয়ে তার যে অহমিকা বোধ ছিল, সেটি যে অন্তঃসারশূন্য তা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়|

দ্বিতীয়ত- নানকিং এর চুক্তি বিদেশিদের বলপূর্বক চীন দেশে অনুপ্রবেশের সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা এবং চীনের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতায় বিদেশিদের সর্বপ্রথম হস্তক্ষেপ| হংকং বিদেশিদের ছেড়ে দেওয়ার ফলে চীনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিপন্ন হয়| উপরন্ত বিদেশি পণ্যের উপর চীন যথেষ্টভাবে শুল্ক আরোপের অধিকার হারায়| এই সবই ছিল চীনের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিপন্থী|


মূল্যায়ন 

সর্বশেষে বলা যায় যে, এই সন্ধির ফলে চীনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল| বিদেশি বণিকদের কাছে পাঁচটি বন্দর উন্মুক্ত হওয়ার ফলে এবং বিদেশি পণ্যের উপর অত্যল্প বাণিজ্য শুল্ক ধার্য করতে বাধ্য থাকার ফলে, বিদেশি পণ্য চীনের বাজারে স্রোতের মতো ঢুকতে থাকে|

এই পর্যন্ত চীনের অর্থনীতি গ্রামীণ এবং সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর| কিন্তু এই স্বয়ম্ভরতা বিনষ্ট হয় বিদেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশের ফলে চীনের অর্থনীতি ক্রমশ আধা উপনিবেশিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়| দেশীয় শিল্প বিদেশি পণ্যের চাপে বিনষ্ট হওয়ায় অসংখ্য মানুষ বেকার ও আধা বেকারের পরিণত হয়| চীন দেশে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ এবং এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল যখন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে চীন বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রভাবাধীন এলাকাতে বিভক্ত হয়ে চীন উপনিবেশের পর্যায় ভুক্ত হয়ে পড়ে|



তথ্যসূত্র

  1. অমিত ভট্টাচার্য, "চীনের রূপান্তরের ইতিহাস 1840-1969"
  2. Jonathan Fenby, "The Penguin History of Modern China".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................


    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐