তেল কূটনীতি কাকে বলে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন শিল্পপতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তেল সম্পদের সংকোচন। মার্কিন শিল্প বিশেষ করে তার পরিবহন শিল্প অক্ষয়ের মুখে এসে দাঁড়াতে থাকে। এর ফলে মার্কিন বিদেশনীতিতে যুক্ত হয় একটি অভিধা তেল কূটনীতি বা তেল রাজনীতি । 

তেল কূটনীতি বা তেল রাজনীতি


এর লক্ষ্য ছিল-

  1. এশিয়া বা ইন্দচিনের চীন, আরব, ইউরোপ, আফ্রিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানের গুরুত্ব স্বীকার করে তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে নিরঙ্কুশ প্রভাব কায়েম করে।
  2. তেল কূটনীতি ও তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার উপর মার্কিন আধিপত্য রক্ষা করা।
  3. তেল মুনাফা থেকে মার্কিন অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চয় ঘটতে থাকে। তেল কূটনীতির সূচনা যে প্রথমে মার্কিনরা করেছিল তা নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তেল কূটনীতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল ব্রিটেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের হাত থেকে তেলের অধিকার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল আমেরিকা।


মধ্যপ্রাচ্যের তেল রাজনীতি

মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল পরিমাণ তেলের খোঁজ পাওয়া যায়। প্রথমে প্রাথমিক পর্যায়ে সেই তেলের দখল নিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। তাই এই সময় কালটিকে থেকে চিহ্নিত করা হয় তেল কূটনীতি বা তেল রাজনীতির শতক হিসাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেন সাম্রাজ্য প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে তেল দমনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। এক্ষেত্রে ব্রিটেনেই প্রথম ছাড়পত্র পায়।  1908 খ্রিস্টাব্দে এঙ্গলো-এড়িয়ান তেল কোম্পানি গড়ে উঠে। ইরান সরকার এরই ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করিনি, কিন্তু রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের তেল এর প্রতি আগ্রহী হওয়়ায় ইরান রাশিয়াকে জড়িয়ে 1908 সালে ব্রিটেনের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তি ইরানকে শাসনের ক্ষেত্র হিসেবে দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেয়। যথা-

১.দেশের উত্তরাংশ রাশিয়ার ভাগে পড়ে এবং ২.দক্ষিণাংশ ব্রিটেনের  ভাগে পড়ে।


তেল কূটনীতি বা তেল রাজনীতির


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এ পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি তেলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদকে কেন্দ্র করে পশ্চিমী শক্তিবর্গ মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। আমেরিকা উপলব্ধি করে যে, তার নিজ দেশের উৎপাদিত তেল তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যের তেল এর দিকে তার নজর পড়ে। গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত সান রেমো চুক্তি বিরুদ্ধে আমেরিকা আপত্তি জানায়। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও বৃটেনের মধ্যে একটি আপস হয় এবং 1925 সালে টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে আমেরিকা 20.2/3 অংশের দায়িত্ব্ব পায়। 

বিশ্বযুদ্ধের আগে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে কিছু সুবিধা লাভের অধিকার পায়।

ইরানের সমস্ত ঋণ রাশিয়া বাতিল করে দেয়। ইরানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর ফলে তেলের উপর দখলের জন্য মধ্য প্রাচ্যের ব্রিটেন এর দায়িত্ব বেড়ে যায়। ফ্রান্স, ডাচ্ এবং আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলিও তাদের অংশ সুনিশ্চিত করে। 1928 সালে "ক্যানপনিয়ান স্ট্যান্ডে ওয়েল কোম্পানি", বাহারিনের সেখ কোম্পানি তেল উত্তোলনের অধিকার লাভ করে। এই কোম্পানি 1933 সালে সৌদি আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অধিকার পেয়ে যায়। তেল কোম্পানিগুলি মধ্যপ্রাচ্যের জীবনচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা স্থানীয় মাতব্বর বা সংশ্লিষ্ট জমির মালিকের সঙ্গে এবিষয়ে চুক্তি করত। এজন্য তাদের রয়েলিটি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হতো। এই অর্থ ব্যয়ীত হলো রেলপথ, মোটরগাড়ি, বিমান, প্রাসাদ প্রভৃতি দিকে।

কিন্তু জনকল্যাণের দিকে এর বিন্দুমাত্র নজর ছিল না। জমিচ্যুত কৃষকদের মধ্যে সামান্য অংশই তেলক্ষেত্রে কাজ পেতে। অবশিষ্ট সামান্য সংখ্যাগরিষ্টের অবস্থা শোচনীয় ছিল। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও এরা বিদেশি শাসনে দাপট মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকার কোম্পানিগুলিকে স্থানীয় উপজাতীয় প্রধানদের মধ্যে বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য সালিশি করার অনুমতি দিয়েছিল। এভাবে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতরা এবং তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা অনেক বাইরে তাদের তৎপরতা শুরু করে। 

1944 সালে সোভিয়েত রাশিয়া ইরানের উত্তরাংশে অধিকার বিষয়ে কয়লার পুনঃস্থাপনের দাবি জানানোর ফলে তেলের দখল নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ইরানের সংসদ মজলিস ঘোষণা করে যে- যতদিন ইরানের মাটি থেকে সমস্ত বিদেশি সৈন্য অপসারণ না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তেলের অধিকার বিষয়ক সমস্ত আলোচনা স্থগিত থাকবে। 1947 সালে ইরানি মজলিস নিজস্ব বিনিয়োগে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে এবং 1951 সালে আইন পাস করে তেল শিল্পের জাতীয়করণ হয়। এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার 1953 সালে একপাক্ষিক চুক্তি বর্জনের প্রতিবাদ জানায়। ইরান ও বৃটেনের এই সমস্যা শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে তোলা হলেও তা নিষ্ফল হয়।

ইইরানের তেল নিয়ে এই কূটনীতিক দ্বিতীয় পর্যায়ে সরাসরি ঢুকে পড়েছিল আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা করতে গিয়ে অজান্তে তারা জড়িয়ে পড়েছিল ইরানের ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে। ইরানি সমাজের শাসক ও উচ্চ বর্গ ছিল সুন্নি গোষ্ঠীর আর শাসিতের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল শিয়া গোষ্ঠীর। সুতরাং পাশ্চাত্য দেশগুলোর মদতে ইরানের শিয়া-সুন্নির দাঙ্গা শুরু হয়। ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা রোমে পালিয়ে যান। পরে আমেরিকার সহযোগিতায় ফিরে আসেন। ক্ষমতায় ফিরে শাহ মোহাম্মদ আমেরিকার সঙ্গে তেলের বিনিময় মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র কেনার চুক্তি করে। 1973 এর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময় তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকার পক্ষে লেনদেনের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধাজনক হয়। কিন্তু 1979 সালে আয়াতোল্লাহ খোমেনি এর নেতৃত্বে ইরানে ইরানী বিপ্লব ( যা ইসলামি বিপ্লব বা 1979 সালের বিপ্লব নামেও পরিচিত) ঘটে। ইরানের নতুন সরকার তেলের উপর পশ্চিমের নিয়ন্ত্রত্রণ অস্বীকার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই ব্যবস্থা হজম করা সম্ভব ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড বাধ্য হয়েছিল ইরানের উপর চাপিয়ে দিতে।

তেল কূটনীতি বা তেল রাজনীতির
সাদ্দাম হোসেন


এই যুদ্ধে তিনি চাপিয়েছিলেন ইরাকের মাধ্যমে। তারই প্রত্যক্ষ মদদেই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন 1980 তে ইরান আক্রমণ করেছিলেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রকাশ্যে নিরপেক্ষতা গ্রহণ করেন। আমেরিকা সমানতালে ইরাক-ইরান দুুই দেশকে অস্ত্র দিয়েছিল। কুয়েত এই সময় তার তেল খনি রক্ষার জন্য আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিল। 1987 সাল থেকে কুয়েত তেল খনির উপর মার্কিন পতাকা উড়তে দেখা দিয়েছিল। 1988 সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে বিরুদ্ধে ঘটে। কোন পক্ষই জয়-পরাজয় এই যুদ্ধে নির্ধারিত হয়নি। আমেরিকার কাছ থেকে ইরাক কিছুু অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছিল এই যুদ্ধে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের কাছ থেকে যে আনুগত্য আশা করেছিল তা দিতে প্রস্তুত ছিল না ইরাক। বরং তেল কূটনীতিতে মার্কিন বিরোধিতার পথেই সাদ্দাম হোসেন মত দিয়েছিল। যার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সঙ্গে সাদ্দামের বিরোধের পরিনিতি কুয়েত আক্রমণের মাধ্যমে। আমেরিকার সঙ্গে ইরাকের বিরোধ ছিল অন্তহীন। 2003 সালে আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে তখন তেল কূটনীতি আরো জটিল হয়ে পড়েছিল। 

পশ্চিম এশিয়া বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম জ্যোতিকা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। বিগত শতকের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগে পর্যন্ত এই দেশটি পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করত। চিনও পিছিয়ে নেই‌। বর্তমান বিশ্ব সে অবস্থায় উপস্থিত হয়েছে তার প্রেক্ষিতে তেলের প্রয়োজনকে অপরিসীম বলে গণ্য করা চলে। শিল্প উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর এই তেলের মজুদ ভান্ডারের অধিকারী পশ্চিম এশিয়ার দেশসমূহ বিশ্বের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে যে মুনাফা তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর পায় তার একটি বড় অংশ তারা অস্ত্রশস্ত্র কেনার পেছনে ব্যয় করে। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো ইসলামী রাষ্ট্রে হলেও বহু ব্যাপারে বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয় নিজেরা বিভেদের দ্বারা আক্রান্ত। তেল বিক্রির অর্থে কেনা অস্ত্র তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে চলেছে। সুতরাং এই সংঘাতের জন্ম তেল থেকেই।


তথ্যসূত্র

  1. Manfred B. Steger, "Globalization: A Very Short Introduction".
  2. BAYLIS ET AL, "The Globalization of World Politics 2nd".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. ওপেক কি ? | What is OPEC ? (আরো পড়ুন)
  2. বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক কীভাবে আজকাল কাজ করে (আরো পড়ুন)
  3. বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আলোচনা (আরো পড়ুন)
  4. বহুজাতিক সংস্থার বৈশিষ্ট্য (আরো পড়ুন)
  5. GATT কি (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................


    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐