ইংরেজদের বিরুদ্ধে হায়দার আলীর সাফল্য এবং টিপু সুলতানের ব্যর্থতা

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে টিপু সুলতানের পরাজয়, মৃত্যু এবং স্বাধীন শক্তিশালী মহীশূর রাজ্যের পতন একটি দিক চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত| ইঙ্গ-মহীশূর সম্পর্ক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হায়দার আলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করলেও তার পুত্র টিপু সুলতান ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত মহীশূর রাজ্যের পতনের জন্য অনেকেই টিপু সুলতানকে দায়ী করেছেন| 

তাই মহীশুরের পতনের জন্য হায়দারের পুত্র টিপু সুলটানকে কতটা দায়ী করা যায়, তা চুলচেরা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে| আসলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হায়দারের সাফল্য ও টিপুর ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করার সময় উভয়ের সমকালীন পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামরিক শক্তির তারতম্য, ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি প্রভৃতির কথা আমাদের মনে রাখতে হবে|

ইংরেজদের-বিরুদ্ধে-হায়দার-আলীর-সাফল্য-এবং-টিপু-সুলতানের-ব্যর্থতা
ব্রিটিশ পতাকা



এই কথা উল্লেখযোগ্য যে, হায়দারের আমলে ভারতে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল, টিপুর আমলে সেইরকম অনুকূল পরিস্থিতি ছিল না, যেমন-
  1. প্রথমত, হায়দারকে লড়তে হয়েছিল কেবল মাত্র ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে| 
  2. দ্বিতীয়ত, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ে মারাঠা অথবা নিজাম উভয়ের সাহায্য পেয়েছিল| 
  3. তৃতীয়ত, হায়দারের শক্তির উৎস ছিল তার তীব্র গতি বিশিষ্ট অশ্বারোহী বাহিনী, এক্ষেত্রে ইংরেজরা তাদের সমকক্ষ ছিল না|
হায়দারের সামরিক প্রতিভা যে খুব উঁচুমানের ছিল তা কিন্তু নয়, আসলে হায়দারের প্রধান শক্তি ছিল তার মনবল| অধ্যাপক নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিনহা বলেছেন, "As a soldier Haidar suffered Respected defeat, but he never despaired".

ইংরেজদের-বিরুদ্ধে-হায়দার-আলীর-সাফল্য-এবং-টিপু-সুলতানের-ব্যর্থতা
অশ্বারোহী সৈন্য


সংখ্যাগত বিচারে হায়দারের সৈন্যবাহিনী ইংরেজদের তুলনায় বেশি ছিল| তাছাড়া হায়দারের সৌভাগ্য যে, প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর(1767-69) যুদ্ধে স্মিত ছাড়া অন্য কোন সুদক্ষ ব্রিটিশ সেনা নায়কের সঙ্গে তাকে মোকাবেলা করতে হয়নি| সুতরাং এই কথা অনস্বীকার্য যে, অনুকূল পরিস্থিতি হায়দারের সফলতার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল|

টিপু যখন ক্ষমতায় আসে, তখন পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে| হায়দারের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ইংরেজ শক্তি ভারতবর্ষে ততটা সুসংগঠিত ছিল না, কিন্তু 1784 খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসনের আইনের মাধ্যমে গভর্নর জেনারেল অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আর কাউন্সিলের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হতো না| এতদিন পর্যন্ত কোম্পানির কাজকর্মে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করত না, কিন্তু এই সময় থেকে তিনি ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে কোম্পানির সম্প্রসারণশীল নীতিকে সরাসরি মদত দিতে থাকে|

সুতরাং টিপু সুলতান যে ইংরেজ শক্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন, তার পিছনে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইংল্যান্ড সরকারের সম্মিলিত প্রয়াস| এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে টিপু সুলতান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং এই ব্যর্থতা ছিল অনিবার্য|

একদল ঐতিহাসিক বলেছেন, অশ্বারোহী বাহিনীর গুরুত্ব হ্রাস করে নতুন রকমের রণনীতি গ্রহণ করে টিপু তার জীবনের মারাত্মক ভুল করেছিলেন| কিন্তু তা সত্ত্বেও টিপুর জীবনীকার ঐতিহাসিক মহিবুল হাসান অশ্বারোহী সৈন্যের গুরুত্ব হ্রাস করে টিপুর পরাজয়ের প্রধান কারণ বলে মনে করেন না| তাই অধ্যাপক মহিবুল হাসান এর মতে, টিপু সুলতান হায়দার আলীর রণকৌশল পুরোপুরি ত্যাগ করেননি বা অশ্বারোহী বাহিনীর ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারেনি|

হায়দার আলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি আত্মমারাত্মক নীতি গ্রহণ করে ইংরেজদের সর্বদা চাপের মধ্যে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন| টিপুর নীতি ছিল আত্মরক্ষামূলক, ফলে ইংরেজরা যুদ্ধের সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাবার যথেষ্ট সময় পেত| চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময় টিপু যদি শ্রীরঙ্গপত্তন রক্ষার জন্য বসে না থেকে প্রথমেই তীব্র আক্রমণ চালাতেন তবে, ইংরেজদের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত|

তবে ইংরেজদের হাতে টিপু সুলতানের পরাজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষে অনৈক্য| বিদেশী শক্তির হওয়ার সত্তেও ইংরেজরা মারাঠা ও নিজামদের গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য পেয়েছিল| মারাঠা ও মহীশূর শক্তি দুটি যদি একজোট হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতো তাহলে হয়তো টিপুর পরাজয় ততটা সহজ হতো না|

ইংরেজদের-বিরুদ্ধে-হায়দার-আলীর-সাফল্য-এবং-টিপু-সুলতানের-ব্যর্থতা
ব্রিটিশ সৈনিক


পরিশেষে বলা যায় যে টিপু সুলতানকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল একটি উন্নত ও সুসংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে| উন্নত পাশ্চাত্য বনাম অনুন্নত ও পশ্চাৎবর্তী ছিল একটি অসম্ভব ব্যাপার| তাছাড়া অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ শক্তি ধনতান্ত্রিক জাল বিস্তারের জন্য যে বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যবাদ নীতি গ্রহণ করেছিল, তা মহীশূরের মতো একটি ক্ষুদ্র শক্তির পক্ষে তা প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না|

তাই টিপুর জীবনীকার মহিবুল হাসান বলেছেন, যদি হায়দার আলী বেঁচে থাকতেন, তাহলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই সময় তার অস্তিত্বকে ধরে রাখতে পারতেন কিনা, তা সন্দেহাতীত|


তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
  3. Dennis Kincaid, "British Social Life In India, 1608–1937".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. 1946 সালের নৌ বিদ্রোহ (আরো পড়ুন)
  2. সম্পদের বহির্গমন তত্ত্ব এবং এটি কিভাবে বাংলার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল  (আরো পড়ুন)
  3. ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন  (আরো পড়ুন)
  4. ঊনবিংশ শতকে নারী সংক্রান্ত সমস্যা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      
        👉 আমাদের ফেসবুক গ্রুপ- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের ফেসবুক পেজ -ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
        👉 চাকুরীর খবর - ক্লিক করুন 🗞️📰 
    
    
    
    
        
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

         
                    
                    
    
    
    
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐