ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যা

1947 সালের স্বাধীনতার সময় দেশভাগের ফলে মূলত পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থী বা উদ্বাস্তুরা বিরাট সংখ্যায় ভারতে প্রবেশ করে| সাধারণভাবে এই অঞ্চলগুলোর সন্নিহিত স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব রাজ্য উদ্বাস্তু সমস্যার প্রভাব সবথেকে বেশি পড়েছিলো| 

প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তীর মতে, পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুরা মূলত দেশভাগের পরেই চলে এসেছিল| কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের আগমন 1947 সালে শুরু হলেও 1971 সালে এমনকি তারপরও অব্যাহত ছিল|

ভারত সরকারের প্রকাশিত উদ্বাস্তু সম্পর্কিত "The history rehabilitation" গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, উদ্বাস্তু সমস্যা ভারত ও পাকিস্তান সরকারের দ্বিপাক্ষিকতা মূলত পাকিস্তানের অসহযোগিতায় উদ্বাস্তু সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে| 1950 সালে ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের নিজের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চুক্তি করে| এই চুক্তির ফলে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগী অনেক মুসলমান পরিচয় ফিরে এলেও হিন্দু পরিবারগুলোকে ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার কোন আগ্রহ দেখাননি| এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের উপর জনসংখ্যার চাপ বাড়ে|

ভারতের-উদ্বাস্তু-সমস্যা
উদ্বাস্তু (মা ও ছেলে)


"History of Indian Agriculture" গ্রন্থে তৃতীয় খণ্ডে পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কথা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে| তাতে জানা যায় যে, পূর্ব পাঞ্জাব থেকে মুসলমান পরিবারগুলো পশ্চিম পাঞ্জাবে চলে গিয়েছিল, অন্যদিকে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে শিখ ও হিন্দু পরিবারগুলো পূর্ব পাঞ্জাবে চলে এসেছিল|

প্রকৃতপক্ষে 1947 খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের সময় যেখানে পাকিস্তান ও ভারত সরকারের মধ্যে যথেষ্ট জনসংখ্যার আদান-প্রদান ঘটে| ধাওয়াল জানিয়েছেন যে, পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত হিন্দু পরিবারগুলোকে গ্রাম ভিত্তিক শরণার্থী শিবির ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে অঞ্চলভিত্তিক মুসলমানদের পরিত্যক্ত গ্রাম ও চাষের জমিতে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল|

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কমিটির প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, 1946 থেকে 1948 সালের মধ্যে পশ্চিমবাংলায় 41 লক্ষ 17 হাজার উদ্বাস্তু এসেছিল| এই সংখ্যা দেখে প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তীর  মনে করেন যে, পশ্চিমবঙ্গে বহুসংখ্যক উদ্বাস্তু এসেছিল এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত জমি অধিকারী চেষ্টা করা হয়, কিন্তু আইনগত জটিলতা জন্য জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি|

ভারতের-উদ্বাস্তু-সমস্যা
উদ্বাস্তু শিবির


পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য গ্রামে গ্রামে চারটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল| এইগুলি ছিল যথাক্রমে-
  1. টাইপ স্কিম 
  2. ইউনিয়ন বোর্ড স্কীম 
  3. কারুজীবি স্কীম
  4. হর্টিকালচার স্কিম
গ্রামীণ এলাকায় কৃষক উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য তিনটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যথা- 
  1. টাইপ স্কিম 
  2. ইউনিয়ন বোর্ড স্কীম
  3. বিশেষ ইউনিয়ন বোর্ড স্কিম
লগ্নি ও পুঁজির অভাবে এই পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থ হবার পর ভারত সরকার পশ্চিম বাংলার বাইরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও বিহারে কিছু অঞ্চলে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়|

বাঙালি উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে সুদূর অঞ্চলে যেতে চাননি, ওই রাজ্যে তারা বামপন্থী দলের সাহায্য পেয়েছিল| কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, কিছু সংখ্যক হলেও উদ্বাস্তু বাংলার বাইরে পুনর্বাসন শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল| তারপরেও দেখা যায় 1952 সালের 1 লা ডিসেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন ক্যাম্পে 84 হাজার 134 জনের সন্ধান মিলেছে|

ভারতের-উদ্বাস্তু-সমস্যা
বর্তমানে ভারতের মানচিত্র


1954 সালের রিপোর্ট হিসাবে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় 64 হাজার 9 শত 61 জন| এরপরেও 1971 সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু আসতে থাকে| পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেতে রাজি না হওয়ায় পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুরা বিশেষ সাহায্য পায়নি|

পাঞ্জাব এবং বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার চরিত্র এবং সমাধানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট তফাৎ ছিল| পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত উদ্বাস্তুরা প্রথম থেকে জমি, কৃষি কাজ ইত্যাদির জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছিল| অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা দেশভাগের সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি দরুন সমস্যায় পড়েছিল|

1952 সালের কোনো এক সময় ত্রাণ মন্ত্রী বিবৃতি থেকে জানা যায় যে, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমস্যা পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি হয়ে দাঁড়িয়েছে| এই সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হবার দরুন বাঙালি উদ্বাস্তুরা নিজেদের বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল| উদ্বাস্তুদের মধ্যে বামপন্থীর প্রভাব পড়েছিল এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল|

ভারতের-উদ্বাস্তু-সমস্যা
জহরলাল নেহেরু


অন্যদিকে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক কারণে বাঙালি উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশের বাইরে পুনর্বাসনের বিরোধিতা করেছিল| অথচ পশ্চিম বাংলায় তাদের পুনর্বাসন দেওয়ার মতো অতিরিক্ত জমি ছিল না| উদ্বাস্তুরাও পশ্চিম বাংলার বাইরে নতুন উপনিবেশ গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল না| এই সমস্ত ঘটনার ফল হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকে| শহরগুলিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তার সাথে সাথে যে বামপন্থী সরকারের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা এককথায় অধ্যাপক প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তীও মেনে নিয়েছিল|


তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
  3. Ishita Banerjee-Dube, "A History of Modern India".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. 1946 সালের নৌ বিদ্রোহ (আরো পড়ুন)
  2. সম্পদের বহির্গমন তত্ত্ব এবং এটি কিভাবে বাংলার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল  (আরো পড়ুন)
  3. ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন  (আরো পড়ুন)
  4. ঊনবিংশ শতকে নারী সংক্রান্ত সমস্যা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      
        👉 আমাদের ফেসবুক গ্রুপ- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের ফেসবুক পেজ -ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
        👉 চাকুরীর খবর - ক্লিক করুন 🗞️📰 
    
    
    
    
        
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

         
                    
                    
    
    
    
    
    
    
    
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐