ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি

1942 খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়| গান্ধীজি পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলনগুলির মধ্যে ব্যাপকতা, বীরত্ব, সংগ্রামী মনোভাব এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা দিক থেকে 1942 খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড় আন্দোলন স্বীয় বৈশিষ্ট্য ভাস্কর| এই আন্দোলনের উদ্ভবের পেছনে যে পরিস্থিতি দায় ছিল, তা নিয়ে আলোচনা করা হলো|

ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি
গান্ধীজি
ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি
গান্ধীজি

ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি



ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

1939 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠে| সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা এই জটিলতা বাড়িয়ে তোলে| 1941 খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধে যোগদানের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়|

ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি



1942 খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে জাপানের সেনাবাহিনী ব্রহ্মদেশের রাজধানী রেঙ্গুন দখল করেন| ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেস উভয় ভারতে জাপানি আক্রমণের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে| এই পরিপেক্ষিতে কংগ্রেস কখনো চাননি ভারতবর্ষ একটা যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে পরিণত হোক| তাই কংগ্রেস ব্রিটেনে যুদ্ধ প্রয়াসের সঙ্গে যাবতীয় সহযোগিতা বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিল| অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠে|

1942 খ্রিস্টাব্দে মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ভারতে আমেরিকান সৈন্যের আগমন শুরু হলে গান্ধীজী বিচলিত হয়ে উঠেন| 1942 খ্রিস্টাব্দে 31 শে মে গান্ধীজীর "হরিজন" পত্রিকায় লিখেন যে, "ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার তাগিদে ভারতীয়রা যেন জাপানের দিকে না ছুটে, এটি প্রতিশোধক রোগের চেয়েও খারাপ"|

কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ বিশেষত রাজেন্দ্র প্রসাদ, বল্লভ ভাই প্যাটেল, সুচেতা কৃপালিনী প্রমূখ এবং কংগ্রেস সমাজবাদী দলের নেতা নরেন্দ্র দেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখেরা গান্ধীজীর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবকে সমর্থন জানান|

ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি
বল্লভ ভাই প্যাটেল


ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র বলেছেন যে, এই সময় ভারতীয় নেতৃবৃন্দ একটি বিশেষ কারণে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম শুরু করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন| তিনি বলেন যে, এই সময় নানা কারণে জনগণের মনোবল ভেঙে যাচ্ছিল এবং নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে, জাপানিরা ভারত দখল করলে জনগণ হয়তো কোনো বাধা দিবে না| এই উদ্দেশ্যে জনগণের হতাশা কাটানো এবং নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস আনার জন্য নেতৃবৃন্দ সংগ্রামের কথা চিন্তা করেন|

তৎকালীন কংগ্রেসের সভাপতি মওলানা আজাদ লিখেছেন যে, জাপানি আক্রমণের সময় গান্ধীজিকে গণসংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়|




ভারত ছাড়ো আন্দোলনের চরিত্র

1942 খ্রিস্টাব্দে 14 ই জুলাই কংগ্রেসের কার্য-নির্বাহক কমিটি ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন| পরবর্তীকালে 1942 খ্রিস্টাব্দে 8 ই আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব পাস করেন এবং 9 ই আগস্ট ভোর বেলা গান্ধীসহ সমস্ত প্রথম সারির নেতাদের বন্দি করা হলে জনসাধারণের মধ্যে এক তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়|

ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি
মিছিল


ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত বড় শহরে হরতাল পালিত হয় এবং বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মিছিল বের হয়| জাতীয় সংগীত ও জাতীয় নেতাদের মুক্তির দাবি ইত্যাদি স্লোগানে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে তুলেছিল|

জ্ঞানেন্দ্রনাথ পান্ডে তাঁর সম্পাদিত "The Indian National in 1942" গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন, "1942 খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল একটি জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন"|

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এই আন্দোলনে বিশেষ অংশ নেননি| জ্ঞানেন্দ্রনাথ পান্ডে তাঁর গ্রন্থে স্পষ্ট বলেছেন, 1942 খ্রিস্টাব্দে আন্দোলনের সময় মুসলিমরা কংগ্রেস থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল| বাংলার গ্রামাঞ্চলের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ছিল মারাত্মক| সরকারের তরফ থেকে বলপূর্বক খাদ্যশস্য মজুদ করা শুরু হয়| রাস্তা থেকে যানবাহন সহ বিভিন্ন যন্ত্র চালিত যান তুলে নেওয়া হয়|

1942 খ্রিস্টাব্দের 17 ই ডিসেম্বর তমলুকে আন্দোলনকারীরা একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলেন| এই সরকারের নামকরণ হয় "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার"| সতীশ সামন্ত, সুনীল ধারা, নীলমণি হাজরা প্রমুখেরা উদ্যোগে এই জাতীয় সরকার গড়ে উঠেছিল|

মহারাষ্ট্রের সাতারা অঞ্চলে নিম্নবর্গীয় মানুষের অংশগ্রহণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অভিনবত্ব এনেছিল| গেইল ও মডেট লিখিত "The satra party sarkar" প্রবন্ধে নিম্নবর্গীয় মানুষরা এই আন্দোলনে যোগদানের একটি চমৎকার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন| গেইল ও মডেট বলেছেন, সাতারার সশস্ত্র বিদ্রোহের লক্ষ্যই ছিল একটি কৃষক-শ্রমিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা|

বিহারেও ভারত ছাড়ো আন্দোলন জঙ্গি রূপ নিয়েছিল| 1942 খ্রিস্টাব্দে ঘটনাবলীর প্রসঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণ লিখেছেন, "একদিকে আমরা ব্রিটিশ সরকারকে একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ছিলাম, অন্যদিকে আমাদের সামনে কোন নির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না"|

ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি
কৃষক
ভারত-ছাড়ো-আন্দোলনের-পটভূমি
কৃষি জমি


ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বিহারের বিভিন্ন জেলায় জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক অভ্যুত্থান এতটাই তীব্র রূপ নেই যে, সরকারি প্রতিবেদনে সারনকে "বিশ্রী রকমের অপরাধী জেলা" বলা হয়েছে| ডেভিড হার্ডিমান তাঁর "The quite India movement in Gujarat" প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, উপরিউক্ত এলাকাগুলির কৃষকরা ব্রিটিশ বিরোধী গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং সরকারি সম্পত্তি ও সরকারের ঘনিষ্ঠ মানুষদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল|


ভারত ছাড়ো আন্দোলনে হিংসার আত্মপ্রকাশ

রাষ্ট্রীয় দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ একটি হিংসাত্মক বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়েছিল| বিহারের সারন, হাজারীবাগ, ভাগলপুর, বাংলার মেদনীপুর, নদীয়া, মালদা, গাজীপুর এবং মহারাষ্ট্রের সাতারা ও নাসিকে এই আন্দোলন তীব্র রূপ নিয়েছিল|

হরতাল, পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ, বোমা ছোড়া প্রভৃতি প্রাত্যাহিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল| পরিস্থিতি এতটাই উত্তাল হয়ে উঠে যে, তৎকালীন ভাইসরয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী অশান্ত জনতাকে শান্ত করার জন্য 15 ই আগস্ট বিমান থেকে মেশিনগান ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন| স্কুল, কলেজ ও কারখানায় ধর্মঘটের ডাক দেওয়া শুরু হয়| কৃষকরা জমিদারকে বিভিন্ন রকমের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়|



তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
  3. Ishita Banerjee-Dube, "A History of Modern India".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. গান্ধীজীর ধারণায় হিন্দ স্বরাজ ও সম্প্রীতি তত্ত্বাবধান (আরো পড়ুন)
  2. সম্পদের বহির্গমন তত্ত্ব এবং এটি কিভাবে বাংলার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল  (আরো পড়ুন)
  3. ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন  (আরো পড়ুন)
  4. ঊনবিংশ শতকে নারী সংক্রান্ত সমস্যা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐