ইউরোপের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রকৃতি এবং বিতর্ক

পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী কাল পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় সর্বত্রই নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল| আলোচ্য পর্বে নানা কারণে এই নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ধারণা প্রতিষ্ঠা প্রায়- গণ সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের উৎপত্তির চুক্তির তত্ত্ব, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল| 

এছাড়া আমেরিকা থেকে রুপোর আমদানি, অজন্মা দুর্ভিক্ষ, মহামারী ষোড়শ শতকে জনজীবনকে বিধ্বস্ত করেছিল| তার উপর ছিল ধর্মযুদ্ধ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ আর এই সব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই প্রয়োজন ছিল সর্বশক্তিমান নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী শাসকের|

ইউরোপের-স্বৈরাচারী-রাজতন্ত্রের-প্রকৃতি-এবং-বিতর্ক
ইউরোপের মানচিত্র


মূলত দুটি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে এই নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী শাসকের ধারণা গড়ে উঠেছিল| একটি হলো জ্যাঁবোঁদার "সার্বভৌম তত্ত্ব", এবং অপরটি মেকিয়াভেলির "রাষ্ট্র সত্ত্বার তত্ত্ব"| ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে চিন্তাবিদ লিপসিয়াস, বাকলার, গ্রাসিয়াস ও হবস এই ধারণাকে আরোও স্থায়ী রূপ দেন| স্বৈরাচারী শাসক তত্ত্বের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার কোন অধিকার নেই, তিনি আইন, বিচার, সাম্য বিভাজনের নিয়ন্ত্রক| দেশের অর্থনীতিও তাঁরই নিয়ন্ত্রণে| রাষ্ট্র সত্তাকে রক্ষার জন্য শাসক যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে|

আলোচ্য পর্বে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহকে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করলেও এর উদ্ভব ও বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়| চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের ইতিহাসে এক সার্বিক ধারণা সৃষ্টি হয়| সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে থাকে|

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসমার্কস তাদের "The Origin of the Family, Private Property and the State" এর জানিয়েছেন যে, ভূমি নির্ভর সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে সাম্য রক্ষাকারী হিসাবে স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা হয়| অর্থাৎ ইতিহাসে কখনো কখনো সময় আসে যখন ব্যতিক্রম হিসেবে যুদ্ধরত শ্রেণীগুলি পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে, আর রাষ্ট্রের ক্ষমতা তখন কিছুটা স্বাধীন হয়ে যায় ও শ্রেণীগুলির মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে এবং শাসক নিজেকে শক্তিশালী করে তোলে|

ইউরোপের-স্বৈরাচারী-রাজতন্ত্রের-প্রকৃতি-এবং-বিতর্ক
মার্কস


মার্কস বলেন, স্বৈরাচারী প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ছিল বেতনভোগী সৈন্যবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থার আমলাতন্ত্র, যাজকতন্ত্র আর এই সমস্ত শ্রেণীকে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে শাসক তার কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও স্বৈরাতান্ত্রিক চিন্তাকে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করে নিজেকে শক্তিশালী করেছিলেন|মার্কসের মতে, ইউরোপীয় ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদের পর এই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল|

তবে পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মার্কস এবং এঙ্গেলস এর মতের বিরুদ্ধ মত লক্ষ্য করা যায়| Peter Perry Anderson এর মতে, ভূমিদাস প্রথা অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের গ্রামাঞ্চল থেকে সামন্ত প্রথা জনিত সম্পর্কের অবসান ঘটেনি| কারণ যতদিন না পর্যন্ত শ্রমকে সামাজিক পরিমণ্ডলে থেকে পৃথক করা সম্ভব ছিল ততদিন পর্যন্ত সামন্ত প্রথার উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেনি|


আলোচ্য পর্বে শ্রমের মূল্য মুদ্রায় রূপান্তরিত না হওয়ায় ভূমিদাস প্রথা থেকে মুক্ত কৃষি শ্রমিকের সামাজিক প্রথাজনিত বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটেনি| এই যুগেও ভূমির মালিক থেকে গিয়েছিলো সামন্ত প্রভুরা এবং উৎপাদন পদ্ধতিও ছিল সামন্ততান্ত্রিক|

ট্রেভার রোপার এর মত ঐতিহাসিকরা চরম রাজতন্ত্রকে মধ্যযুগের রাজতন্ত্রের চরম বিকশিত রূপ বলে উল্লেখ করেছেন| স্বৈরতন্ত্র ইউরোপে নতুন পেশাদার সেনাবাহিনী গঠন করেছিল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও রণকৌশল বিপ্লব ঘটে, যা চরম রাজতন্ত্রের উত্থানে সহায়ক হয়েছিল|

ঐতিহাসিক জন উলরিক নেফ মনে করেন, যুদ্ধবিদ্যার অগ্রগতি বিশেষত বারুদের আবিষ্কার চরম রাজতন্ত্রের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল| উন্নত মানের কামান ও আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে সামন্তদের দুর্গ, তলোয়ার প্রভৃতি অকেজো হয়ে পড়েছিল| এই রাজতন্ত্র নিজস্ব পেশাদার সৈন্য বাহিনী দিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধি করে আয় বৃদ্ধি করতো| তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকরা বলেন চরম রাজতন্ত্রের চরিত্র ছিল সামন্ততান্ত্রিক|

ইউরোপের-স্বৈরাচারী-রাজতন্ত্রের-প্রকৃতি-এবং-বিতর্ক
দুর্গ


স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র মার্কেন্টাইল অর্থনীতি অনুসরণ করতো| ঐতিহাসিক হিল্টনমরিস ডব চরম রাজতন্ত্রের অধীনে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে বড় অর্থনৈতিক কার্যক্রম রূপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন| ঐতিহাসিক ব্রোদেল এইসময় রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে ইউরোপে নগর, বাজার, পরিবহন ব্যবস্থা এবং মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন|

চরম রাজতন্ত্রের বিকাশ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণে মরিস ডব প্রমুখ ঐতিহাসিক রাজতন্ত্রকে সামন্ততান্ত্রিক বলেছেন|তবে তারা সপ্তদশ শতকের ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিকে সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে সন্ধিক্ষণ পর্ব বলে বর্ণনা করেছেন| সামন্ততন্ত্র নিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের উদ্ভবের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠে| Anderson মনে করেন, এই সময় রাজতন্ত্রের অধীনে প্রশাসনের ক্রমবিস্তারের ফলে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী শ্রেণীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে|



তথ্যসূত্র

  1. অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
  2. George A Henty, "In the Reign of Terror".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐