ঊনবিংশ শতকের হিন্দু পুনরুজ্জীবন আন্দোলন

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী রাজনীতির পাশাপাশি এক ধরনের ভাববাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে| এই আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে রাজনৈতিক চরমপন্থা পুষ্ট হয়| অস্পষ্টভাবে এই ভাবাদর্শগত ধারণাকে "হিন্দু পুনরুজ্জীবন" (Hindu Revival) বলা হয়ে থাকে|

আরেকটু পরিস্কার ভাবে বলা যায় যে, হিন্দু ধর্মীয় ইতিহাসে বিভিন্ন কল্প কাহিনী এবং প্রতীক চিহ্নের মাধ্যমে প্রধানত ভারতীয় জাতিকে বুঝে নেওয়ার একটি উদ্যোগ| ধর্মকে কেন্দ্র করে দুটি ধারার বিকাশ করতে দেখা যায়, একটি হলো সংস্কারের ধারা এবং অপরটি হলো পুনরুজ্জীবন ধারা|

সংস্কারমূলক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল, ভিতর থেকে হিন্দু সামাজিক সংগঠন ও আচরণের পরিবর্তন ঘটানো, যাতে সেগুলি পাশ্চাত্যের নতুন যুক্তিবাদী ধারনার অনুসারী হয়ে উঠতে পারে| অন্যদিকে পুনরুজ্জীবন ধারার মূল লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় সবকিছুতেই গর্ববোধ করা| এর মূলে ছিল হিন্দু সভ্যতার গৌরবময় অতীতের ধারণা| উনিশ শতকের শেষের দিকে সংস্কারবাদী ধারা ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে এবং পুনরুজ্জীবনের ধারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠে|

ঊনবিংশ-শতকের-হিন্দু-পুনরুজ্জীবন-আন্দোলন
বর্তমানে ভারতের মানচিত্র
ঊনবিংশ-শতকের-হিন্দু-পুনরুজ্জীবন-আন্দোলন
বিবেকানন্দের মূর্তি


1870 খ্রিস্টাব্দ পর থেকে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ও বিভাজনের কারণে ব্রাহ্মসমাজ দুর্বল হয়ে উঠতে থাকে| এই পরিস্থিতিতে 1880 দশকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে| শ্রীরামকৃষ্ণের আবেদন ছিল, "মানুষের হৃদয়ের কাছে, ভাবের কাছে"| তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার মূল্যবোধকে বাতিল করে দেয়| উনিশ শতকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কাছে যুক্তিবাদ ক্রমশই বিরাগের কারণ হয়ে উঠেছিল|

তাই রামকৃষ্ণের ভক্তিবাদের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী খুঁজে পেয়েছিল এক নতুন ধর্মীয় জীবন| পার্থ চ্যাটার্জি বলেছেন, "এই ধর্মীয় জীবন মানুষকে পরিশুদ্ধ করে, প্রাচীন জ্ঞানানুগ করে তুলে"| শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শকে বিবেকানন্দ তুলে ধরেন, তিনি মানুষের সেবা করাকে "ঈশ্বর সেবা" বলে প্রচার করেন|

বিবেকানন্দকে যথার্থ অর্থে পুনরুজ্জীবনবাদী না বলা হলে এই কথা সত্য যে, ঐতিহ্য ছিল তার প্রেরণার উৎস| তাঁর মধ্যে নিহিত ছিল হিন্দু সভ্যতার গৌরবময় ঐতিহ্যের বিশ্বাস| বিবেকানন্দের এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত ছিল স্বদেশ প্রেম| এই চরমপন্থী নেতাদের ও বিপ্লবীদের সমগ্র প্রজন্মের কাছে বিবেকানন্দ "পথ প্রদর্শক ঋষি" বলে গণ্য হয়ে থাকেন|


বাংলায় ধীরে ধীরে একটি বুদ্ধিদীপ্ত ধারা বিকশিত হতে থাকে| এই ধারার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ঐতিহ্যকে সর্বজন গ্রাহ্য, মান ও ন্যায়সঙ্গত করে তোলা| প্রতিষ্টিত হয় "ভারতীয় আর্য ধর্ম প্রচারিণী সভা" এর মত কিছু সংগঠন| বেদ, পুরান বিধৃত ধর্মকে পুনর্জীবিত করায় ছিল এসব সংগঠনের লক্ষ্য|

অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরো পরিমার্জিতভাবে কিংবদন্তি কৃষ্ণকে আধুনিক জাতির নির্মাতা হিসেবে তুলে ধরেন| 1882 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত "আনন্দমঠ" উপন্যাসে তিনি মাতৃভূমিকে দেবীমাতা হিসেবে অবতারণা করেন এবং বন্দেমাতরম সংগীত রচনা করেন| তিনি মনে করতেন, জাতির ধর্মীয় পুনর্জাগরণ ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল সম্ভব নয়| তাই তাঁর আদর্শ ছিল পুনর্জাগরণমুলক| কিন্তু কখনোই গোড়ামি যুক্ত নয়|
ঊনবিংশ-শতকের-হিন্দু-পুনরুজ্জীবন-আন্দোলন
আন্দোলন


মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক ও তাঁর পুনা সার্বজনীন সভা একসঙ্গে মহারাষ্ট্রে আন্দোলন পরিচালনা করেন| এরা হিন্দু ব্রাহ্মণ ও মারাঠা গৌরবের জয়গান করতেন| এরা বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক কুপ্রথাকে উৎখাটিত উদঘাটিত করার কথা বলেছেন| এদের প্রচারের ফলে হিন্দু মেয়েদের বিবাহের বয়স 10 বছর থেকে বাড়িয়ে 12 বছর করা হয়| কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালায়|

রুখমাবাই মামলার (আরো পড়ুন) মধ্য দিয়ে হিন্দু গোড়ামি তার পুরুষতান্ত্রিক অধিকারকে ঘোষণা করেন| শেষ পর্যন্ত 1891 খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে বিবাহের বয়স সম্মতি বিষয়ক বিল পাস হয়| কিন্তু হিন্দু মহিলা বিবাহ ও সম্মতি বিষয়ক বিতর্ক থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে আক্রমণের একটা হাতিয়ার হতে পারে ধর্ম|

আর্য সমাজ গো-রক্ষক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগঠনের স্বার্থে সনাতন হিন্দু ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার চরম আকার নেয়| 1875 খ্রিস্টাব্দে দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন| তিনি বেদ ভিত্তিক প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের মহিমাকে তুলে ধরেন| ফলে এই আন্দোলনকে পুনর্জাগরণবাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়| আর্য সমাজে শুদ্ধির ধারণার প্রচলন ঘটে গো-রক্ষক বিষয়কে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে| গরুকে প্রতীক করে হিন্দুদের আন্দোলন গড়ে ওঠে|

ভাষাকে কেন্দ্র করে হিন্দু পুনরুজ্জীবন ঘটে| উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও অযোধ্যায় উর্দু-হিন্দি বিতর্ক শুরু হয় 1860 এর নাগাদ| 1890 এর দশকে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে| হিন্দি ভাষা হয়ে উঠে হিন্দুদের এবং উর্দু হয়ে উঠে মুসলমানদের|

1900 খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে উত্তর-পশ্চিম ও অযোধ্যার সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করে উর্দু সঙ্গে সংস্কৃতকে সমান সরকারি মর্যাদা দেয়| এর ফলে মুসলমান সমাজে উর্দু ভাষাকে রক্ষা করার সংগঠন গড়ে উঠে| ভাষা হয়ে উঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়|

সিং সভা আন্দোলনের মাধ্যমে বিশিষ্ট শিখ সত্ত্বা সুসংবদ্ধ ভাবে গড়ে উঠে| এই ঘটনা ছিল পাঞ্জাবের আর্য সমাজ আন্দোলনের সরাসরি পরিনাম| উনিশ শতকের শেষের এবং বিংশ শতকে গড়াতে এইভাবে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় পুনর্জাগরণবাদি ধ্যান-ধারণার মেলবন্ধন ঘটে|

ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করতে গিয়ে জাগ্রত করা হয় হিন্দু সম্প্রদায়কে| রাজনৈতিক প্রয়োজনে পুনর্গঠিত হয় হিন্দু ধর্ম| জেগে উঠে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, এর ফলে মুসলমান, শিখ সম্প্রদায় দূরে সরে যায়|


তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারতের ইতিহাস"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
  3. Sonali Bansal, "Modern Indian History".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
              ......................................................

নবীনতর পূর্বতন
👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️

    
  
  👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
  


  

   

    👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
  


  

   
  
  
    👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️

    👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 


    
  

  

টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


 


 





👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️



👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

👉ক্লিক করুন 🌐