ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ

রনজিৎ সিং এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শিখ শক্তির পতনের দিকে ধাবিত হয়। তার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের ভিত্তি এমনিটেই দুর্বল, তার উপর তার উত্তরাধিকারীরা প্রত্যেকেই ছিলেন অপদার্থ ও অযোগ্য এবং তাদের পক্ষে নবজাগ্রত শিখ শক্তির স্বার্থ রক্ষা করা অসম্ভব ছিল।

ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ
ব্রিটিশ পতাকা
ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ
শিখ


শিখ সর্দারদের মধ্যে কোন ঐক্য ছিল না। তারা ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। এর ফলস্বরূপ রনজিৎ সিং এর মৃত্যুর পর এক অরাজকতা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে রনজিৎ সিং এর পুত্রদের মধ্যে এক গৃহবিবাদের সূত্রপাত হয়। শেষ পর্যন্ত খালসা বাহিনী এর দুই নায়ক লাল সিং ও তেজ সিং রনজিৎ সিংহের নাবালক পুত্র দলীপ সিংহকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্যের সকল ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রাজমাতা ঝিন্দনকে দলীপ সিংহের অভিভাবিকা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।


প্রথম ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ

খালসা বাহিনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলে অবস্থার জটিল হয়ে উঠে। দরবারে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। শেখ নেতৃবৃন্দের পক্ষে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর ছিলো না। বরং সেনাবাহিনী সরকারকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে সচেষ্ট হয়। 

শেষ পর্যন্ত লাহোর দরবারে সেনাবাহিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তা শিখ জাতির পতনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে। রাজমাতা ঝিন্দন সামরিক বাহিনী ইংরেজ রাজ্য আক্রমণে উৎসাহিত করতে থাকেন। এই ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বিন্যাস করা। বলাবাহুল্য শিখ সৈন্যবাহিনী ও এই সময়ে এক চরম অধঃপতন ও দৈন্য দশার মধ্যে পড়েছিল। 

শিখদের এই অনৈক্য ও রাষ্ট্রশক্তির দুর্বলতা সময় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিরব ছিলেন না। এই সুযোগে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে তৎপর হন। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ শতদ্রু নদীর পূর্ব তুরস্ক দুর্গগুলিতে ইংরেজ সৈন্যরা সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। সেখানে তাদের নিয়মিত কুচকাওয়াজ শুরু হয়। শতদ্রুর উপর সেতু নির্মাণ শুরু হয়। ইংরেজদের এইসব কার্যকলাপেে শিখরা শঙ্কিত হয়ে উঠে। তাছাড়া লাহোর দরবারে অবস্থিত ইংরেজ রেসিডেন্ট মেজর ব্রডফুটের উদ্বৃত্ত আচরণ ও অপমানজনক ব্যবহার শিখদের ক্ষুব্দ করে তুলে। 

ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ
ব্রিটিশ সৈনিক


অবশেষে 1845 সালে 11ই ডিসেম্বর খালসা বাহিনী অমৃতসরের সন্ধি উপেক্ষা করে শতদ্রু অতিক্রম করে ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমণ করলে "প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ" শুরু হয়। মুটকী(1846 খ্রিস্টাব্দ), ফিরোজ শাহ (1845 খ্রিস্টাব্দ), আলিওয়াল(1846 খ্রিস্টাব্দ) ও সহেব্রাও(1846 খ্রিস্টাব্দ)- এর যুদ্ধে যথার্থ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তেজ সিংহ ও লাল সিংহের নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতায় চারটি যুদ্ধেই শিখ বাহিনী পরাজিত হয়।


লাহোর সন্ধি

ব্রিটিশ সেনাদল লাহোর দখল করলে শিখরা লাহোর সন্ধিতে(1846 খ্রিস্টাব্দে, 9 মার্চ) অপমানজনক স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্তানুসারে শিখরা -
  1. বিপাশা ও শত্রুর মধ্যবর্তী জলন্ধর-দোয়াব এবং শতদ্রু নদীর দক্ষিণস্ত সমস্ত ভূভাগ ইংরেজদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
  2. যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সিকদের দেড় কোটি টাকা দিতে বলা হয়, কিন্তু এত টাকা দেবার সামর্থ্য শিখদের না থাকায় তারা কাশী রাজ্যটি ইংরেজদের ছেড়ে দেয়। কোম্পানির জনৈক ডোগরা গোলার সিংহের নিকট কাশী বিক্রি করে দেন।
  3. শিখদের সৈন্য সংখ্যা হ্রাস করা হয়।
  4. লাহোরে একজন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট থাকবে বলে স্থির হয়।  স্যার হেনরি লরেন্স এই পদ অলংকৃত করেন। ক্রমে তিনি ইংরেজ সৈন্যের সহায়তায়়় শিখ রাজ্যের প্রকৃত শাসক হয়ে উঠেন।


দ্বিতীয় ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ

স্বাধীনতা প্রিয় শিখদের পক্ষে লাহোরের অপমানজনক সন্ধি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। লাহোরের ইংরেজ সেনাদলের অবস্থিতি এবং ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জন লরেন্স ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও শিখ নেতৃবৃন্দের প্রতি অপমানজনক ব্যবস্থায় শিখদের বিক্ষিপ্ত করে তোলে। ষড়যন্ত্রের লিপ্ত থাকার অভিযোগে রাজমাতা ঝিন্দনকে চুনার দুর্গে নিবাসী করা হলে এক ভারতের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ অচিরেই বিদ্রোহে পরিণত হয়।

ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ

তবে যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়, তা হলো মুলতানের শাসক মুলরাজকে কেন্দ্র করে। লাহোর দরবারের সঙ্গে মুলরাজের মত বিরোধ হলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং তার জায়গায় লাহোর দরবারে খান সিংহকে মুলতানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে দরবারে Vans Agnew (ড্যান্স এগনিউ) এবং Anderson (এন্ডারসন) নামে দু'জন ইংরেজ কর্মচারীকে মুলতানের নবনিযুক্ত শাসনকর্তা শেরসিংহ স্বপদে বহাল করতে মুলতানের উপস্থিত হয় বা পাঠানো হয়। মুলরাজ এই দুজন কর্মচারীকে হত্যা করে বিরোধী হয়ে উঠেন। হাজরার শাসনকর্তা ছত্তর সিংহও এই বিরোধে যোগ দেয় এবং সমগ্র পাঞ্জাব বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে।

পরিস্থিতি আরও জড়ালো হয় যখন মুলরাজকে দমন করার জন্য শেরসিংহকে প্রেরণ করা হলে তিনিও ইংরেজ পক্ষ ত্যাগ করে মুলরাজের পক্ষে যোগদান করেন। পেশোয়া ফিরে পাবার আসায় আফগানিস্তানের আমীর দোস্ত মুহাম্মদ শিখদের পক্ষে যোগদান করে এবং সমগ্র পাঞ্জাব জ্বলে উঠে। এই অবস্থায় লর্ড ডালহৌসি 1848 সালে 10ই অক্টোবর শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। 

ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ

চিলিয়ান ওয়ালার যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড গাফ পরাজিত হলেও কিন্তু গুজরাটের যুদ্ধে (1849, ফেব্রুয়ারি) ইংরেজ জয়ী হয় এবং শিখরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। লর্ড ডালহৌসি কলকাতার কাউন্সিলিং বা ইংল্যান্ডস্ত কর্তৃপক্ষের মতামতের উপেক্ষা করেই সমগ্র পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন। বিদ্রোহের অভিযোগে দলীপ সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করে ইংরেজদের বৃত্তিভোগী হয়ে লন্ডনে নির্বাসন করা হয়। খালসা বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয় এবং এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন আফগানিস্তানের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত হয়।


ইঙ্গ শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়ের কারণ ও ফলাফল

বিদ্রোহের অজুহাতে দলীপ সিংহের পদচ্যুতি ও ইংরেজদের পাঞ্জাব অধিকার নৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো দিক থেকেই সমর্থনযোগ্য নয়। মুলরাজের বিদ্রোহ ও তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দলীপ সিংহ কোনক্রমে দায়ী ছিলেন না। কারণ পাঞ্জাব প্রশাসনের সকল দায়িত্বই তখন লাহোরের অবস্থিত ইংরেজ রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত ছিল।  তাছাড়া মহারাজা দলীপ সিংহ ছিলেন একজন অল্পবয়স্ক শাসক (নাবালক) এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত শিখ বিদ্রোহের তিনি জড়িত ছিলেন না। 

ইঙ্গ শিখ যুদ্ধ

নাবালক রাজা দলীপ সিংহ এর পক্ষে শাসন কার্য পরিচালনার জন্য যে আটজন শিখ সর্দার সদস্য নিয়ে গঠিত অভিভাবক সভার দুজন সদস্য শেখ বিদ্রোহের মদত দিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হলে বাকিরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। এমনকি কুড়ি হাজার শিখ সৈন্য বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের পাশে ছিল। সুতরাং দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের জন্য লর্ড ডালহৌসি যে সম্পূর্ণভাবে শিখদের দায়ী করেছেন তা সমর্থন যোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে ডালহৌসি মুলরাজের বিদ্রোহের অজুহাতে সমগ্র পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং এর সার্থক রূপ দেয়। সেইজন্য ঐতিহাসিক জেমস মিল, কানিংহাম প্রমূখ ঐতিহাসিকেরা এই যুদ্ধের জন্য কোম্পানির আগ্রাসী নীতিকে দায়ী করেছেন। এছাড়া জনৈক ঐতিহাসিক লর্ড ডালহৌসির পাঞ্জাব দখলকে চরম বিশ্বাস ঘাতকতা বলে বর্ণনা করেছেন।  সুতরাং একথা বললে অযুক্তি হবে না যে, ডালহৌসির পাঞ্জাব দখল ছিল ব্রিটিশ নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত রূপ ও প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 


এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পাঞ্জাব দখলের ফলে কোম্পানির সাম্রাজ্য রাজ্যসীমা আফগানিস্তানকে স্পর্শ করে এবং এর ফলে কোম্পানিকে আফগান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদি পাঞ্জাব দখল না করে মিত্র রাজ্য হিসেবে পাঞ্জাবের অস্তিত্ব বজায় রাখা হতো তাহলে আফগান সমস্যার আঁচ সরাসরি কোম্পানি গায়ে লাগতো না। তাই কোন কোন ঐতিহাসিক ডালহৌসির কর্তৃক পাঞ্জাব কোম্পানির রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক ভ্রান্তি বলে উল্লেখ করেছেন। 



তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারতের ইতিহাস"
  2. Om Prakash, "Lord William Bentinck and Metcalfe Era of Reforms".
  3. Sonali Bansal, "Modern Indian History".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
              ......................................................

নবীনতর পূর্বতন
👉 আমাদের অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ- ক্লিক করুন 🙋‍♂️

    
  
  
    👉 আমাদের ফেসবুক গ্রুপ- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
  


  

   
  
  
    👉 আমাদের ফেসবুক পেজ -ক্লিক করুন 🙋‍♂️

    👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 


    
  
    👉 চাকুরীর খবর - ক্লিক করুন 🗞️📰 


    
  

টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

     
                
                







টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


 


 





👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️



👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

👉ক্লিক করুন 🌐